মাতৃগর্ভেও বাঁচতে পারলো না শিশুটি

Slider জাতীয়

35964_lead

 

ঢাকা; মর্মান্তিক। অকল্পনীয়। হাসপাতালের প্রবেশপথে হঠাৎ প্রাণঘাতী হয়ে উঠলো একটি অ্যাম্বুলেন্স। অদক্ষ চালকের বেপরোয়া গতি কেড়ে নিলো মাতৃগর্ভের সন্তানকেও। কয়েক মাস পরই পৃথিবীর আলো দেখার কথা ছিল শিশুটির। তা আর কোনো দিনও হবে না। বাঁচানো যায়নি তার মা আমেনা বেগম সূর্যকেও। গুলনূর সর্দার (৩০) ও তার ৭ বছরের সন্তান সাকিব এবং অপর এক অজ্ঞাত পরিচয় ভিক্ষুক। মাতৃগর্ভের শিশুসহ মুহূর্তেই ৫ জনের প্রাণহানি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রবেশপথে গতকাল সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন। মাতৃগর্ভে নিহত সন্তানকে সরিয়ে নেয়ার পর সন্ধ্যার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সূর্য। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে নিহত আমেনা বেগম সূর্যের ছেলে সজীব (৮), নিহত গুলনূরের ৭ মাসের কোলের সন্তান, বাচ্চু মিয়া (৩৫), রমজান আলী (৩৫)। তাদের ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনার পর পর অ্যাম্বুলেন্সটির চালকের আসনে থাকা সহকারী সোহেল (১৮)কে আটক করেছে ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ি। জব্দ করা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সটিও। শাহবাগ থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী শাহ আলম মানবজমিনকে বলেন, সকালে হাসপাতালে রোগীর সমাগম বাড়ছিল। জরুরি বিভাগের গেট দিয়ে
লোকজন ঢুকছিল ও বের হচ্ছিল। এ সময় একটি দ্রুতগতির অ্যাম্বুলেস জরুরি বিভাগের গেটে ঢুকছিল। গেটের একপাশে দাঁড়ানো ছিল গুলনূর, তার ছেলে সাকিব ও তাদের বহন করে আনা রিকশাটি। হাসপাতাল থেকে খাবার আনতে যাচ্ছিল সূর্য ও তার ছেলে সজীব। এক ভিক্ষুক পাশে বসে ভিক্ষা করছিল। এলোমেলোভাবে ছিল আরো বেশ কিছু লোক। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সটি জোরে ধাক্কা দেয়। তাতে গাড়ির চাকার নিচে পড়ে যায় সাকিব। পিষ্ট হন ভিক্ষুকটিও। আর সাকিবের মা গুলনূরের শরীরের একাংশ গাড়ির চাকার নিচে পড়ে। তার কোলে থাকা শিশুটি চাকার বাইরে থাকায় বেঁেচ গেছে। চিৎ হয়ে পড়ায় তার মাথায় কিছুটা আঘাত পেয়েছে। এ সময় গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে পড়ে যান সূর্য। তার সঙ্গে থাকা ছেলে সজীবের দুটি পা ভেঙে যায়। আরো কয়েকজন আহত হন। এ সময় পাশে থাকা এক পুলিশ সদস্য ওই চালককে ধরে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেলেন। তখন লাশ ও আহতদের দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। যেন যুদ্ধক্ষেত্র। এতে গেটের একাংশও ভেঙে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের উদ্ধার করে জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। তিনজনকে মৃত ঘোষণার পর বাকিদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জানা যায়, নিহত সূর্যের স্বামী জাকির হোসেন একজন ট্রাকচালক। তিনি গত ২৪শে আগস্ট চট্টগ্রামে একটি দুর্ঘটনায় আহত হন। এরপর ভর্তি হন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। সেখানে স্ত্রী সূর্য ও তার ছেলে সজীব তার দেখাশোনা করছিলেন। গতকাল সকালে খাবারের জন্য সূর্য ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে যাওয়ার সময় এ দুর্ঘটনার শিকার হন।
নিহত গুলনূর ও সাকিবের আত্মীয় রাবেয়া বেগম ও আল আমিন জানান, তাদের বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী থানার চাহিরচর এলাকার চাতলাখালী এলাকায়। গুলনূরের স্বামী ফেরদৌস ঢাকায় থাকেন। ভ্যানগাড়ি চালান। তাদের ছিল তিন ছেলে পারভেজ (৯), নিহত সাকিব ও ৭ মাসের ছেলে আকাশ। কিছুদিন ধরে সাকিবের চোখে অসুখ দেখা দিয়েছিল। বৃহস্পতিবার তাকে নেয়া হয়েছিল পটুয়াখালী সদরে। সেখানে পূজার বন্ধে চিকিৎসক না পেয়ে গত শুক্রবার তাকে ঢাকায় আনা হয়। ওই দিন ফারুক নামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। গতকাল শনিবার সকালে একটি রিকশা নিয়ে ফেরদৌস হাসপাতালে আসেন। তার কাছে রিকশা ভাড়ার টাকা দেয়ার জন্য ভাংতি ছিল না। তাই তিনি ৫০০ টাকার নোট ভাঙানোর জন্য কিছুটা দূরে যান। গেটে দাঁড় করিয়ে রাখেন স্ত্রী, সন্তান ও রিকশাচালককে। সেখানে তার শ্বশুরও ছিলেন। এরপর আওয়াজ শুনেই ছুটে এসে দেখেন তার সব শেষ। সন্তানের চোখের আলো যাতে না নিভে যায় সেই চিকিৎসার জন্য আসা সন্তানের চোখের আলো চিরতরে নিভে গেছে। হারিয়ে গেছে তার স্ত্রীও। এরপর থেকেই তিনি নির্বাক। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতাল চত্বরে তাকে নির্বাক অবস্থায় দেখা গেছে।
শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘাতক সোহল চালক নয়, অ্যাম্বুলেন্সটির সহকারী। জিজ্ঞাসাবাদে সে বলেছে, ব্রেকের পরিবর্তে এক্সেলে চাপ পড়েছে। এতে গাড়িটি দ্রুতগতিতে গিয়ে সামনে যাদের পেয়েছে পিষ্ট করে গেছে।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ৭ মাসের আকাশ: আকাশকে নিয়ে দাঁড়ানো ছিলেন নিহত গুলনূর। গাড়িটি তাকে ধাক্কা দেয়ার সময় আকাশ তার পাশে বুকের কাছে ছিল। গাড়িটি তাকে এক পাশ থেকে পিষ্ট করে গেলেও অপর পাশে ছিল আকাশ। মায়ের সঙ্গে সেও চিৎ হয়ে পড়ে যায়। মাথার পেছনে কিছুটা থেতলে গেলেও সে ছিল চাকার বাইরে। এতেই সে বেঁচে গেছে। দুর্ঘটনার পরপর তাকে তুলে নেয় তার নানা। তবে তার বড় ভাই সাকিব গাড়ির চাকার নিচে চলে যাওয়ায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে।
যেভাবে দুর্ঘটনা: গাড়িটি ছিল মেডিকেলের বাইরে। একটা লাশ পরিবহনের জন্য চালক সোহাগ ঘাতক সহকারী সোহলকে বলে গাড়িটি জরুরি বিভাগের ভেতরে ঢোকানোর জন্য। তখন সে গাড়িটি জরুরি বিভাগের গেট দিয়ে মোড় নিয়ে ঢুকছিল। এ সময় সে ভুলে পা রাখে এক্সেলে। এতে গাড়িটির গতি বেড়ে যায় আর প্রাণহানি ঘটে ওই ৪ জনের। সোহেল কুমিল্লার মনোহরদী থানার সরেশপুর এলাকার দুলাল মিয়ার পুত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *