মা-বোনকেও জঙ্গি দলে টেনেছিল আকাশ

Slider নারী ও শিশু

35204_f2

 

ঢাকা;  কিশোরগঞ্জের সরকারি গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র পরিচয়ে শহরের নীলগঞ্জ রোড এলাকার ‘পরশমণি’ বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গি আকাশ। বলেছিল, সে অর্থনীতি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। ওই সময় নাম বলে জয়নাল আবেদীন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার আসিমপুর বাজার এলাকায় তার বাড়ি এবং বাবা আসিমপুর বাজারে ধান-চালের স্টক ব্যবসায়ী বলেও পরিচয় দেয়। কিন্তু গত ১লা জুলাই বাসা ভাড়া নেয়ার সময় দেয়া তথ্যের সবই ছিল ভুয়া। সেই জয়নাল আবেদীন ওরফে জঙ্গি আকাশ শনিবার গাজীপুরের নোয়াগাঁও এলাকার পাতারটেকে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়। এরপরই বেরিয়ে আসে তার আসল পরিচয়। ছবি দেখে গতকাল দুপুরে আকাশকে শনাক্ত করেন ‘পরশমণি’র মালিক মো. আবদুস সাত্তার। এই আকাশই তার মা-বোনকে জঙ্গি দলে টেনে নিয়েছিল।
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্ধাইল ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ইতলী গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে জঙ্গি আকাশ নিজ এলাকায় ফরিদুল ইসলাম নামে পরিচিত। বছর ২ আগে সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা পাস করেছেন। এরপরই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়।
কিশোরগঞ্জ শহরের বাড়ির মালিক আবদুস সাত্তার জানান, নিহত জঙ্গি আকাশই ছাত্র পরিচয় দিয়ে এবং জয়নাল আবেদীন নাম ব্যবহার করে তার বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল। গুরুদয়াল কলেজের সে-সহ চারজন ছাত্র থাকার কথা বলে মাসিক ছয় হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে দুই হাজার টাকা জয়নাল অগ্রিমও দিয়েছিল। পহেলা জুলাই ভাড়া ঠিক করার পরদিন ২রা জুলাই দুপুরে সে একা বাসায় উঠেছিল। চারজন বাসায় থাকার কথা বললেও জয়নাল আবেদীন নামের ওই ছেলেটিকে ছাড়া আর কাউকে তিনি দেখেননি। ৭ই জুলাই ঈদের দিন সকালে তার স্ত্রী শামসুন্নাহার ‘ভাড়াটিয়া ছাত্র’দের জন্য সেমাই ও পিঠা তৈরি করে দিলে তিনি সেগুলো নিয়ে নিচতলায় সিঁড়ি লাগোয়া ভাড়া দেয়া কক্ষের দরজার সামনে যান। দরজায় নক করার পর জয়নাল আবেদীন দরজা খুলে সামনে থেকেই সেমাই ও পিঠা নেয়। পরে শোলাকিয়া থেকে নামাজ পড়ে আর বাসায় ফিরবে না জানিয়ে ভাড়াটিয়া জয়নাল বাড়িওয়ালা আবদুস সাত্তারের হাতে চাবি বুঝিয়ে দেয়। ঈদের পরদিন এসে বাসায় উঠবে বলেও সে জানিয়েছিল। পরে ঈদের দিন রাতে র‌্যাব তার বাসায় এলে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলাকারীরা তার বাসাতেই আস্তানা গেড়েছিল বলে তিনি জানতে পারেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকেও ‘পরশমণি’ বাসাটি জয়নাল আবেদীন নামে নিহত জঙ্গি আকাশ ভাড়া করেছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নিহত জঙ্গি আকাশ শোলাকিয়া হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী। সে ‘নিউ জেএমবি’র ঢাকা বিভাগের অপারেশন কমান্ডার ছিল। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার গান্ধাইল ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ইতলী গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে ফরিদুল ইসলাম ওরফে আকাশ (২৫)। তার বাবা-মা, দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ৮ ও ৯ বছর বয়সী দুই ভাইবোন ছাড়া সবাই এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। গত ৫ই সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশ তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আকাশের মা ফুলেরা খাতুন (৪৫), দুই বোন সাকিলা খাতুন (১৮) ও সালমা খাতুনকে (১৬) গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় ওই বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই ও একটি কম্পিউটার জব্দ করা হয়। তারা আত্মঘাতী দলের সদস্য ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। ৭-৮ বছর বয়সী ২ ভাই-বোনকে নিয়ে বাবা আবু সাঈদ রয়েছে পলাতক। অভিযানের সময় আকাশের বাবা আবু সাঈদকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। নিহত জঙ্গি আকাশ গত বছর সিরাজগঞ্জের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা করেছে। এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শোলাকিয়া হামলায় কেবল নিহত জঙ্গি আকাশ নয়, সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত জিয়া, মেজর জাহিদ ও তামিম চৌধুরীরও প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। এ জন্য তারা কিশোরগঞ্জে অবস্থানও করে। ‘পরশমণি’ নির্মাণাধীন বহুতল ভবনটির নিচতলার পশ্চিম পাশের ইউনিটে বসেই শোলাকিয়া হামলার মূল ছক তৈরি করা হয়। ঈদগাহ ময়দান থেকে ১৫-২০ মিনিটের মতো পায়ে হাঁটা দূরত্বের এই বাসা থেকেই দফায় দফায় রেকি করা হয়। ঈদের দিন সকালে নিহত জঙ্গি আবির রহমান এবং র‌্যাবের হাতে আটক ও পরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ওরফে সাইফুল ইসলামকে হামলার দায়িত্ব দিয়ে বাকিরা কিশোরগঞ্জ ছেড়ে যায়। হামলার দিন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জঙ্গি শফিউল আটক হলে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে এসব তথ্য পান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় এবং মেজর জাহিদ মিরপুরের রূপনগরে নিহত হয়।
বড়ইতলী গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য ইসমাইল হোসেন জানান, মিডিয়ার মাধ্যমে গতকালই (শনিবার) গ্রামের লোকজন আকাশের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছে। জঙ্গি নিহতের এ ঘটনায় এলাকার লোকজন  খুশি। ২ বছর আগে ফরিদুল ইসলাম আকাশ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। তার বাবা আবু সাঈদ গত রোজার আগ থেকে গাঢাকা দিয়েছে। এরপর মাঝে মধ্যে বাড়ি এলে ৩ মাস যাবৎ আর আসছে না। ৫ই সেপ্টেম্বর তার মা, ২ বোন ও এক প্রতিবেশীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই পরিবারের লোকজন কারও সঙ্গে মিশতো না। তাদের পরিবার এককভাবে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশে ঈদ উদযাপনের একদিন আগে ঈদ পালন করতো। এই গ্রামে আকাশের আরো সহযোগী আছে দাবি করে তিনি বলেন, আকাশের মা ও ২ বোন গ্রেপ্তার হওয়ার পরই তাদের বাড়ির পাশের আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী আছিয়া খাতুন (২২) পরিবারের ৭-৮ জন সদস্য নিয়ে উধাও হয়। একই এলাকার আবদুল মালেকের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ও তার মা এবং শহিদুল ইসলামের স্ত্রী আশফুল খাতুনও গাঢাকা দিয়েছে। এদের সঙ্গে আকাশের পরিবারের গভীর সখ্য ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *