সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি নির্ধারণ করবে সরকার

Slider জাতীয়

34309_f1

 

ঢাকা; স্বাধীনতার পর অবশেষে প্রথম বারের মতো চূড়ান্ত হচ্ছে শিক্ষা আইন। গত পাঁচ বছর ধরে নানা প্রক্রিয়া শেষে গত বুধবার শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আইনে নোট গাইড নিষিদ্ধ করা হলেও কোচিং সেন্টার বহাল থাকার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সব স্তরের শিক্ষার টিউশন ফি নির্ধারণ করে দেবে সরকার এবং তা মনিটরিং করতে আলাদা রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা কথা বলা হয়েছে খসড়ায়। থাকছে তিন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা। সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারে নিয়ন্ত্রণে আসবে। আইন লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে আইনে। আইনে কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধ না করে বরং শিক্ষার মানোন্নয়নের সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে কোচিং সেন্টারসমূহের শিক্ষা (সহায়ক) কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে খসড়া আইনে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পেলে কোচিং সেন্টার সরকার বন্ধ করতে পারবে। ৪৯টি ধারাসংবলিত এই শিক্ষা আইন মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের জন্য শিগগিরই পাঠানো হবে বলে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা স্তরের সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। এজন্য একটি ‘রেগুলেটরি কমিশন’ গঠন করা হবে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মূল্যায়ন  অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অনুমোদন নিয়ে দূরশিক্ষণ এবং ই-লার্নিং পদ্ধতিতে কোর্স বা প্রোগ্রাম চালাতে পারবে। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয় ও উন্নয়ন করবে। আইনের খসড়া অনুযায়ী, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তর, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর, স্নাতক বা তদূর্ধ্ব উচ্চশিক্ষা স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পর্যায়ক্রমে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালু করা হবে। প্রাথমিক স্তরের ভর্তির ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিবন্ধন নিতে হবে। বিদেশি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেল বা সমপর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন নিতে হবে।  অমান্য করলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছর কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি স্থায়ী বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।
জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগোলিক আবস্থান ও গুরুত্ব, অনগ্রসরতা, দূরত্ব, প্রতিকূল যোগাযোগ ব্যবস্থা, নদী ভাঙন ইত্যাদি বিবেচনা করে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার স্তর পর্যন্ত একীভূত, একত্রীকরণ, স্থানান্তর, বিলুপ্ত করা যাবে। সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো  ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। আইন ভঙ্গ করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তবে প্রবাসী বাংলাদেশীরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইন অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বাংলাদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারবেন। প্রস্তাবিত আইনে কোনো প্রকার নোট বই গাইড প্রকাশ করা যাবে না। তবে সহায়ক বই বা ডিজিটাল শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রকাশ করতে পারবে। খসড়া আইন অনুযায়ী কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না।
আইনে শিশুবান্ধব শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি, ভর্তি, ধর্ম শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, ১৫ বছর ও তদূর্ধ্বদের বয়স্ক শিক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। স্কুলের পাশাপাশি মাদরাসায় অভিন্ন পাঠ্যবই থাকবে। কওমি মাদরাসার শিক্ষার উন্নয়নে সরকার গুরুত্ব দেবে। সকল প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শিক্ষক-অভিভাবক পরিষদ গঠন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল আয়-ব্যয় ব্যাংক হিসেবের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, রাষ্ট্র বা শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে শিক্ষকদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সর্বোপরি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। শিক্ষার্থীদের কোনো প্রকার শারীরিক শাস্তি বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। ৪৯টি ধারাসংবলিত খসড়া আইন থেকে বহুল আলোচিত প্রশ্নফাঁস-সংক্রান্ত বিধান তুলে দেয়া হয়েছে। এর আগের খসড়ায় এ বিধান ছিল।
প্রসঙ্গত, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে ২০১১ সালে শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে (আইন ও অডিট) আহ্বায়ক করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কয়েকজন সদস্যকে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটি ২০১২ সালে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করে। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ই আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য আইনের খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট মন্তব্য না থাকায় পরবর্তীতে নানা বিতর্ক দেখা দেয়। এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও সাবেক এক শিক্ষা সচিব নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। গত বছর খসড়া আইন ফের মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে দিয়েও কয়েক দিনের মধ্যে তুলে নেয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *