নতুন রাজাকার, নদী দখলদার!

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি বাধ ভাঙ্গা মত

14463198_312025379153901_3347336366469820465_n

ঢাকা; গত রোববার নদীরক্ষা কমিশন ও নদী পরিব্রাজক দলের আলোচনা সভায় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান নদী দখলদার ও দূষণকারীদের এ যুগের রাজাকার বলে অভিহিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আগে মানুষ বিকেলবেলা বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে যেত। এখন সে নদী প্রভাবশালীরা দখল করেছে, পানি দূষিত করেছে।’ (প্রথম আলো, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬)
তবে মন্ত্রী বলেননি কারা সেই প্রভাবশালী। কারা এ যুগের রাজাকার। আমরা যদি নদী, বালু, চর, সড়ক, সেতু ও স্থলের দিকে তাকাই, দেখতে পাব সর্বত্র ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য। মন্ত্রী কি এ যুগের রাজাকার ও প্রভাবশালী বলতে তাঁদেরই বুঝিয়েছেন? সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো তাঁদের চিহ্নিত করা।
আন্তর্জাতিক নদী দিবসে মন্ত্রী মহোদয় যখন নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বলেছেন, তখন দেশবাসী দেখতে চাইবে তাঁরা কোন দলের এবং তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
আওয়ামী লীগের আমলে যেখানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কিংবা জামিন নিতে আদালতের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে বাধ্য হচ্ছেন, সেখানে তাঁদের পক্ষে নদী, চর, সেতু, সড়ক ও জমি দখল করা কঠিন। গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হলেও নদী দখলের কারণে একটি মামলা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। সে ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি বিরোধী দল এসব নদী দখল ও দূষণের সঙ্গে জড়িত নয়। আর বিরোধী দলের কেউ কেউ জড়িত হয়ে থাকলে তাঁরা ভোল পাল্টে সরকারি দলেই নাম লিখিয়ে ফেলছেন। আমরা এও দেখেছি যে বিরোধী দলে থাকতে যাঁরা দেশদ্রোহী ও স্বাধীনতার শত্রু ছিলেন, সরকারি দলে এসে তাঁরাই খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়েছেন। তাঁদের বলা হয় পিজিপি বা প্রেজেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি।
মন্ত্রী নদী দখলদারদের এ যুগের রাজাকার বলেছেন। রাজাকার শব্দটির আভিধানিক অর্থ যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশে রাজাকারেরা দেশবিরোধী ও মানবতাবিরোধী হিসেবেই চিহ্নিত। আওয়ামী লীগ সরকার একাত্তরের রাজাকারদের বিচার করছে এবং মানুষ সেই বিচারকে সমর্থনও করছে। মন্ত্রী যখন সেই রাজাকারদের সঙ্গে নদী দখলদার ও নদী দূষণকারীদের তুলনা করছেন, তখন আমরা ধরে নিতে পারি তিনি এঁদের ভয়ংকর অপরাধী বলেই গণ্য করেন। এখন প্রশ্ন হলো, এ যুগের রাজাকারদের তিনি বিচার করছেন না কেন? তাঁরা নদী হত্যা করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত এবং পরিবেশকে বিপন্ন করছেন। গণমাধ্যমে তাঁদের ছবিও ছাপা হচ্ছে। তারপরও কেন মন্ত্রী তাঁদের ধরছেন না?
অন্যান্য দখল ও দূষণের দায় তিনি অস্বীকার করলেও নদী দখল ও দূষণের দায়িত্ব তাঁকে নিতেই হবে। জনগণ তাঁকে নদী ও নৌপথ সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয় আছে, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ আছে। তারা কী করছে? আমরা দেখি, নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীর তীর থেকে যেসব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করে, কিছুদিন পর তারা ফের সেখানে ফের স্থাপনা বসায়। অনেকটা সাপ লুডু খেলার মতো। আর তুরাগে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ খুঁটিই গেড়েছে নদীর সীমানা থেকে অনেক ভেতরে গিয়ে। এতে দখলদারদের সুবিধা হয়েছে। যে নদী তারা অবৈধভাবে দখল করেছিল, সেই দখল বৈধতা পেয়েছে।
কেবল নদী নয়, সড়ক, সেতু, জমি, জলা—সবই দখল হয়ে যাচ্ছে। কারা করছে? মন্ত্রী বলছেন প্রভাবশালীরা। আমরা শুনেছি, সরকারের হাত অনেক লম্বা। তারা ইচ্ছে করলে যেকোনো স্থানে গিয়ে যেকোনো লোককে পাকড়াও করতে পারে। কিন্তু কথিত প্রভাবশালীদের হাত মনে হচ্ছে নৌমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের চেয়েও লম্বা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্ব নদী ও নৌপথ সুরক্ষা করা। সেটি করতে যে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোই এর প্রমাণ। একাধিকবার তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে মিরপুর থেকে সদরঘাট নৌপথ চালু করেও টিকিয়ে রাখতে পারেননি। মন্ত্রী মহোদয়ের ভাষায়, এ যুগের রাজাকারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি বলেই গত সাত বছরে নদীগুলো আরও বেশি দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে। এই দূষণ যে কী ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে, তা যেকোনো দিন বুড়িগঙ্গার পাড়ে কেউ গেলেই টের পাবেন। সভা-সেমিনারে নদী দখলদার ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে গরম কথা বললেই নদী দখলমুক্ত হয় না। সে জন্য কাজ করে দেখাতে হয়। সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে শাজাহান খান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু একটি নদীও তিনি দখল ও দূষণমুক্ত করতে পারেননি। তিনি কীভাবে এ যুগের রাজাকারদের ধরবেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *