ভয়ঙ্কর মোবাইল মাদকতা

Slider সারাদেশ

file-1

 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী শান্তনা বসাক। ২৮শে আগস্ট ২০১৬। বিকাল সোয়া ৪টা। হঠাৎই সব শেষ। পদ্মা এক্সপ্রেসের নিচে চাপা পড়ে মারা যান সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী। একটি জীবনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় একটি পরিবারের স্বপ্নও।
সেসময় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, শান্তনা বসাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পাশের রেললাইনে হেঁটে হেঁটে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। কানে হেডফোন লাগানো ছিল। চারুকলা গেটে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বেশ কয়েকবার তাকে রেললাইন থেকে সরে যেতে বললেও তিনি খেয়াল করেননি। ওই সময় রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনটি চারুকলা গেট অতিক্রম করছিল। পেছন থেকে আসা ট্রেনটি হর্ন বাজালেও ফোনালাপে মগ্ন শান্তনা বুঝতে পারেননি। ট্রেনটি ধাক্কা মারলে শান্তনা গুরুতর আহন হন। পরে শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে চিকিৎসা শুরুর আগেই তার মৃত্যু হয়।
শান্তনা বসাক একা নন। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অনেক। মুহূর্তের অসাবধানতা শেষ করে দিচ্ছে সব। একটি জীবন, একটি পরিবারের স্বপ্ন। মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে গিয়ে অনেকেই বিপদ ডেকে আনছেন। মোবাইলে মগ্ন থাকার কারণে গাড়ির হর্নের আওয়াজ কানে যাচ্ছে না। মোবাইলের ভয়ঙ্কর ব্যবহারে প্রায়শই মত্ত হন চালকেরা। গাড়ি চালাতে চালাতেই গল্পে মেতে থাকেন তারা। নিজের এবং যাত্রীদের জন্য ডেকে নিয়ে আসেন বিপর্যয়। এগুলো দেখারও যেন কেউ নেই। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মোটামুটি অর্ধেকের হাতে এখন মোবাইল। তাদের অনেকেই এখন আসক্ত হয়ে পড়ছেন মোবাইলে। বিশেষ করে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে রাতদিন মগ্ন থাকেন মোবাইল ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ। আশপাশের জীবন আর পরিবার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন তারা। শিশুদের জন্য মোবাইল আসক্তি সবচেয়ে বিপজ্জনক। মোবাইল ফোনে সেলফি তুলতে গিয়েও ঘটছে নানা অঘটন। অনেকে আবার মোবাইল ব্যবহার করেন পর্নো দেখার কাজেও। পরিস্থিতি উত্তরণে প্রয়োজন সতর্কতা।
মোবাইলে মগ্ন, ট্রেনের নিচে ব্যবসায়ী
গত মে মাসে রাজশাহীর চারঘাটে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে শাহাদাত হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হন। ৫৫ বছর বয়সী এ ব্যবসায়ী ছিলেন পুঠিয়ার বানেশ্বর বাজার বণিক সমিতির সহসভাপতি। প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী আন্তঃনগর ট্রেন মহানন্দা এক্সপ্রেস সারদা রেলস্টেশনের মাত্র ২০০ গজ দূরে ছিল। এ সময় অসাবধানবশত রেললাইন পার হতে গিয়ে শাহাদত হোসেন ট্রেনের নিচে কাটা পড়লে ঘটনাস্থালেই তার মৃত্যু হয়। ঈশ্বরদী জিআরপি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জোবায়ের হোসেন সেসময় জানিয়েছিলেন, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ওই ব্যবসায়ী রেললাইন পার হচ্ছিলেন। মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও তিনি বুঝতে না পারায় কাটা পড়ে নিহত হন।
কানে মোবাইল, নিহত জবি ছাত্র
ঘটনাটি গত ১৭ই মে-র। এক হাতে মোবাইল ফোন কানে ধরে কথা বলছিলেন, অন্য হাতে ছিল পছন্দের আইসক্রিম। এভাবে রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. ওবায়দুল্লাহ (২৪)। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া মসজিদের পাশে রেললাইনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ওবায়দুল্লাহ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার শার্শা উপজেলায়। পুলিশের বরাতে তখন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিক হয়- ‘দুপুর ১টার দিকে নাখালপাড়ায় একটি ট্রেনের নিচে কাটা পড়েন ওবায়দুল্লাহ। প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাদের বলেছে, রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ওই ছাত্র এক হাতে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন, অন্য হাতে আইসক্রিম ছিল। এ সময় ঢাকা থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি আসতে দেখে লোকজন তাকে সরতে বলে। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ লোকজনের চিৎকার শুনতে পাননি। পরে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
শিশুরা জড়িয়ে যাচ্ছে আসক্তিতে
অনলাইন আসক্তিতে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে শিশুরাও। বলা বাহুল্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা মোবাইলেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। শিশুদের অনলাইন আসক্তি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিসি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউটিউবে বাচ্চারা শিশুতোষসহ বিভিন্ন ভিডিও দেখতে দেখতে অনেক সময় ঢুকে পড়ে নিষিদ্ধ সাইটে। পর্নোগ্রাফিতে আসক্তিও হয় এভাবে অনেকের।
ছয় বছরের শিশু জাওয়াদ (প্রকৃত নাম নয়) আমাকে দেখাচ্ছিল তার নিজেরই একটি আইপ্যাড আছে। সেখানে  সে ইউটিউবে ভিডিও দেখে। গেমস খেলে। রাইমস শোনে। বাবা-মা বাসায় না থাকলে এভাবেই তার সময় কাটে বেশি। আবার নাহিয়ানের (ছদ্মনাম) নিজের দুটো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। একটি বন্ধুদের জন্য, অপরটি আত্মীয়স্বজনদের জন্য। ট্যাব আছে দুটি। বাচ্চাদের খাওয়াতে গিয়ে কিংবা বিভিন্ন ধরনের রাইমস শেখাতে গিয়ে বাবা-মাও তাদের সামনে মোবাইল বা কম্পিউটারে মেলে ধরেন গেমস বা ভিডিও। কখনো নিজেদের ব্যস্ততার কারণে ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখেন এভাবে। শিশুদের সামাজিকতার বিকাশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যা চিন্তিত করছে অভিভাবকদেরও।
পেশায় একজন ফিজিওথেরাপিস্ট নাসরীন আহমেদ। তার ১৩ বছরের ছেলে মোহাম্মদপুরের একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ছে। সে তার বন্ধুবান্ধব বা কাজিনদের সঙ্গে ব্যস্ত থাকে অনলাইনে নানান গেমস নিয়ে। মাঠে গিয়ে খেলায় তাদের উৎসাহ নেই। বাবা-মাও সময়ের অভাবে নিয়ে যেতে পারেন না। একাও ছাড়তে চান না। জানান মিসেস আহমেদ। স্কুল, কোচিংশেষে পড়াশোনার চাপ সামলে বাইরে খেলতে যেতে আগ্রহ পাচ্ছে না তারা। আবার কোনো কোনো শিশু শিক্ষার্থী জানালো, তারা বাইরে খেলতে যেতে চাইলেও সে সুযোগ নেই। স্কুলগুলোতে মোবাইল ফোন বা ট্যাব ব্যবহারের বিষয়ে কঠোর কড়াকড়ি থাকলেও অনেকসময় তা লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনালের প্রিন্সিপাল এ এম এম খাইরুল বাশার বলেন, বিশ্বের অনেকে জায়গায় বর্তমানে অনলাইন আসক্তিকে বলা হচ্ছে ‘ডিজিটাল কোকেন’। বাংলাদেশেও সামপ্রতিক কয়েক বছরে বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্কুল এবং অভিভাবক উভয়কেই ভূমিকা নিতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন তিনি।
গৃহিণী নুসরাত ফাতেমা নিজে একসময় নজরুল সংগীত গাইতেন। তার দুই সন্তানকেও গান বা আবৃত্তির মতো কোনো চর্চায় ব্যস্ত রাখতে চেয়েছেন। ক্রিকেট বা ফুটবল ক্লাবেও ভর্তি করাতে চেয়েছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে সন্তানদের আগ্রহ নেই। লেখাপড়া আর ঘুমের সময়টুকু বাদ দিয়ে তারা ব্যস্ত থাকে মোবাইল আর কম্পিউটার নিয়ে। কিন্তু এই প্রযুক্তিনির্ভরতা এবং অনলাইন আসক্তি শিশুদের জীবনে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, জানাচ্ছেন মনো চিকিৎসকরা। এখান থেকে অনেক সময় নিষিদ্ধ সাইটগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটে যাচ্ছে শিশুদের। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু কিশোর ও পারিবারিক বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন এ ধরনের আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করছে। তিনি আরো বলেন, এর ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা তৈরি হয়। একটানা দীর্ঘসময় মোবাইল বা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে একদিকে চোখের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে, তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা। শিশুদের কল্পনাশক্তি, চিন্তা শক্তিও কমে যাচ্ছে, বলেন বিশেষজ্ঞরা।
আইনে শাস্তি সামান্য, কার্যকারিতা নেই
গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা রোধ করতে ২০০৭ সালে মোটরযান আইনের সংশোধন করা হয়। ওই বছর ১২ই জুলাই মোটরযান আইনের ১১৫(বি) ধারার সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইন অমান্য করলে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু এ আইনের তেমন কোনো কার্যকারিতা দেখা যায় না। সড়কে-মহাসড়কে প্রায়শই চালকদের মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। এমনকি অনেকে মোটরসাইকেল চালানোর সময়ও কথা বলেন মোবাইল ফোনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই মোবাইল ফোনে চালকদের কথা বলা বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে আরও কঠোর আইন প্রয়োজন। প্রয়োজন আইনকে কার্যকর করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *