নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার যেন হিড়িক পড়ে গিয়েছে। কখনও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের নেতা কানহাইয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জেলে পোরা হচ্ছে। কখনও মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতে পটেল আন্দোলনকারী নেতা হার্দিক পটেলের বিরুদ্ধে এই মামলা হচ্ছে। কখনও অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খোলায় অভিনেতা আমির খান ও তাঁর স্ত্রী-র বিরুদ্ধে মামলা। কখনও বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর উল্টো সুরে ‘পাকিস্তান নরক নয়’ বলায় কন্নড় অভিনেত্রী রম্যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। ২০১৪ সালেই গোটা দেশে এমন ৪৭টি মামলা করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৮ জনকে। কিন্তু মাত্র এক জন ছাড়া কাউকে শেষ পর্যন্ত শাস্তি দিতে পারেনি সরকার।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার এই অপব্যবহার রুখতেই ‘কমন কজ’ নামে একটি সংস্থা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। সেই মামলার ভিত্তিতেই শীর্ষ আদালত সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সরকারের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করলেই তা রাষ্ট্রদ্রোহ হয়ে যায় না। কোনও বিষয় আদৌ রাষ্ট্রদ্রোহ কিনা, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। শীর্ষ আদালত আবেদনকারী সংস্থার আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে জানিয়েছে, গোটা দেশের কোথায় এই আইনের অপব্যবহার হয়েছে, সে সব সুপ্রিম কোর্টের সামনে আনতে। আদালত মামলাগুলি বিবেচনা করে রায় দেবে।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি কী?
ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারা অনুযায়ী, কথায়, ইঙ্গিতে বা অন্য ভাবে বৈধ সরকারের অবমাননা করতে চাইলে, ঘৃণা বা অসন্তোষ ছড়াতে চাইলে জরিমানা-সহ তিন বছর পর্যন্ত জেল বা যাবজ্জীবন হতে পারে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি তৈরি হয় পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমন করতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আইনটি বরাবর বিতর্কে থেকেছে। ১৯৬২ সালে কেদারনাথ সিংহ বনাম বিহার সরকারের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা সামনে নিয়ে আসে। শীর্ষ আদালত বলে, হিংসা ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা হলে কিংবা সংবিধানে বাক্ স্বাধীনতার এক্তিয়ারের পরিধি লঙ্ঘন হলেই রাষ্ট্রদোহের অভিযোগ আনা যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি দীপক মিশ্র ও উদয় ইউ ললিতের বেঞ্চ এখন সাংবিধানিক বেঞ্চের সেই রায়কেই অক্ষরে অক্ষরে পালন করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বিচারপতিরা বলেছেন, প্রত্যেক ম্যাজিস্ট্রেটকে কেদার নাথ মামলার রায় মেনে চলতে হবে।
আবেদনকারীর আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ের পরেও কোনও সরকারই আইন বদলাতে এগিয়ে আসেনি। ফলে মামলার সময় পুলিশের কাছে আদালতে ব্যাখ্যা সংক্রান্ত তথ্য থাকে না। আবেদনকারীর অভিযোগ, মাওবাদীদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চিকিৎসক বিনায়ক সেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনেছিল ছত্তীসগঢ় সরকার। শীর্ষ আদালত সেই অভিযোগ পরে খারিজ করে দেয়। সেই সময় ইউপিএ সরকারের আইনমন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি আইন সংশোধনের কথা বলেও পরে পিছিয়ে আসেন। তবে এখন শাসক দল বিজেপির বক্তব্য, আইনের অপব্যবহারের শিকার সকলেই। খোদ অরুণ জেটলির বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছিল তাঁর একটি নিবন্ধের জন্য। যেখানে তিনি বিচার ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের এক বিচারক নিজে থেকেই জেটলির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার নির্দেশ দেন। পরে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই বিচারককে সাসপেন্ড করে দেয়। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইনটি পর্যালোচনার জন্য ইতিমধ্যেই আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা