মির্জা ফখরুলের কান্না ও আমাদের রাজনীতি

Slider বাধ ভাঙ্গা মত সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

14183845_10202053174846368_7836568645677890313_n

দলীয় নেতা-কর্মীদের দুর্দশার বর্ণনা করতে গিয়ে প্রকাশ্য সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কান্না নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অধিকাংশই তার কান্নাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে তীব্র কটাক্ষ করতেও ছাড়ছেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে না পারার মর্মবেদনা থেকেই তিনি কেঁদেছেন বলে দাবী করেছেন শাসক দলের এক নেতা। শিশুশিল্পী ঈশিতার অভিনয় দেখে সেসময়ের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অশ্রুসজল হওয়ার কথা মনে করিয়েছেন কেউ। ফুটবল তারকা নেইমার ও মেসির কান্নার প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন আমার এক প্রিয় সাহিত্যিক। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে নিপীড়িত মানুষেরা যখন কেঁদেছে, কিংবা সরকার বিরোধী সহিংস আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের দুঃখ-কষ্টের সময় মির্জা ফখরুল কী করেছিলেন সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যার কাছে যেমন মনে হবে, তিনি তেমন অনুভূতি ব্যক্ত করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে ফখরুল সাহেবের ‘অশ্রুবাণ’ সরকারি দল ও তাদের সমর্থকদেরও যে বিব্রত করেছে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট। জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে চোখের জলই অনেক বেশি অন্তর্জ¡ালা সৃষ্টি করেছে অনেকের।

দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে দলের প্রতিটি নেতিবাচক কাজের দায় মির্জা ফখরুল কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে অল্প-বিস্তর ধারণা যাদের আছে তারা নিশ্চয়ই জানেন, ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলগুলোর মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদকদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, উপলব্ধির বাস্তবায়ন কতটা সীমিত। ভিন্ন মতাদর্শের একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে জনাব ফখরুলের সঙ্গে আমার মেশার তেমন সুযোগ হয়নি। তার সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয়েছিলো প্রায় পাঁচ বছর আগে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মোহাম্মদপুরের বাসায়। সেদিন দলীয় সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এসেছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতৃবৃন্দের কাছে বেগম খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণ পৌঁছে দিতে। সুযোগ পেয়ে ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির নেতিবাচক কর্মকা-ের তীব্র সমালোচনা করেছিলাম আমি। দলীয় সভাপতির বাড়িতে আসা অতিথিদের সঙ্গে ওভাবে কথা বলা হয়তো শিষ্টাচারের কিছুটা লঙ্ঘন হয়েছিলো, কিন্তু অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে কথাগুলো শুনেছিলেন তারা।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর রহস্যজনক গুম হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে হরতাল চলছিলো তখন। প্রথম দিনের হরতালে সমর্থন দিলেও টানা হরতালের কারণে শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাতে আমরা¬ ২০১২ সনের ২৪শে এপ্রিল গিয়েছিলাম বিএনপি’র নয়াপল্টনের অফিসে। সেদিনও ইলিয়াস আলীর শিশু কন্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে মির্জা ফখরুলের ঠোঁট কেঁপে উঠছিলো বারবার, ভারী হয়ে আসছিলো কণ্ঠ। বাবা হারানো এক শিশুর করুণ আর্তি তাকে স্পর্শ করেছিলো। যদিও বিএনপি অফিসে ঢোকার সময় আমাদের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। এই ন্যাক্কারজনক কর্মকা-ের প্রতিবাদে প্রচ- ক্ষোভে দুপুরের তপ্ত পিচঢালা পথে গামছা বিছিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী শুয়ে পড়লে আটক নেতা-কর্মীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তারা। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এরপরও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, কুশল বিনিময় হয়েছে তার সঙ্গে। গত রমজানে সৌদী দূতাবাসের ইফতার মাহফিলে একই টেবিলে বসার সুবাদে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। আবারও দীর্ঘক্ষণ কথা হয় বঙ্গবীরের বাসায় এবছর জুলাই মাসের শেষ দিকে। সর্বশেষ দেখা হয় গত ৪ঠা আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসায়।

ময়লার গাড়ি পোড়ানোর মামলায় মির্জা ফখরুল একবার গ্রেফতার হলে, সহমর্মিতা জানাতে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমরা। স্বামী যার জেলে, সেই স্ত্রীকে কী বলে সান্তনা দেবো, মনে মনে সেটাই ভাবছিলাম। কিন্তু আমাদের দেখেই মিসেস ফখরুল বললেন, “আমার স্বামী কোন অপরাধ করে জেলে যায় নি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য জেলে গেছে। আপনারা ওর জন্য, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।” আমরা তাকে কী সাহস দেবো, তিনিই উল্টো দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমাদের আশার বাণী শোনালেন। জেলতো দূরের কথা, অনেক বড় বড় নেতার স্ত্রীকে দেখেছি স্বামীর ‘রাজনীতি-ফাজনীতি’ করাই পছন্দ করেন না। বাড়িতে লোকজনের ভীড়-বাট্টায় মহাবিরক্ত থাকেন। সেসব নেতার তুলনায় মির্জা ফখরুলকে মহাসৌভাগ্যবান না বলে কোনো উপায় নেই।

এই ক’দিনের চলাফেরা, কথাবার্তায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমার একজন নিপাট ভদ্রলোক বলেই মনে হয়েছে। রাজনীতি পছন্দ করেন না এমন একজন স্কুল শিক্ষক কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিলেন, মির্জা ফখরুলের ব্যক্তিত্বকে তিনি পছন্দ করেন। ওই স্কুল শিক্ষকসহ আরও অনেকের মতো আমিও তাকে মানবিক সংবেদনশীল মানুষ হিসেবেই মনে করি। আমি বিশ্বাস করি, তার সেদিনের কান্না, সন্তানের দুর্বিসহ জীবনযন্ত্রনা সহ্য করতে না পারা একজন পিতার কান্না। চোখের সামনে জলে ডুবে যেতে থাকা স্বজনকে উদ্ধার করতে না পারার ব্যর্থতার করুণ আর্তনাদ। তাই যে কোন ব্যক্তির মানবিক অনুভূতির প্রকাশকে আমরা যদি মানবিকভাবেই বিবেচনা করতে সক্ষম হই, তবে আমাদের দেশের অনেক সমস্যা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে।

১.৯.১৬

প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী: কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম-সম্পাদক
ই-মেইল:  [email protected]

সেল: ০১৭১১৬৪০৩৭৫, ০১৯২৯৯১৮৮১১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *