বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধ শুরু

Slider জাতীয় ফুলজান বিবির বাংলা শিক্ষা সারাদেশ
b0a411791b9ca0d0018134581e688370-Untitled-13
ঢাকা: আট বছর ধরে শুধু আলোচনাই হচ্ছে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেডিকেল কলেজের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার পদ্ধতি চালু হলো না। ফলে এবারও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তাঁদের ছুটে বেড়াতে হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
অভিযোগ আছে, মুখে মুখে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কার্যত ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফরম বিক্রি থেকে পাওয়া আয় হারানোর ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে চায় না।
ইতিমধ্যে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করেছে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ। এতে আগের মতোই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, এবার প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে ছোটাছুটি করতে হবে। সাধারণত একজন শিক্ষার্থী ১০ থেকে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে থাকেন।
বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর ফলাফলের ভিত্তিতে কে কোন মেডিকেলে পড়বেন, তা ঠিক হয়ে যায়। এই পদ্ধতি স্বচ্ছ হওয়ায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দেশের শিক্ষাবিদেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই পদ্ধতি চালু করার পক্ষে আট বছর ধরে মত দিয়ে আসছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে আসছে। তবে ৩৮টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একসঙ্গে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হতে পারে বলে শিক্ষাবিদেরা গুচ্ছ পদ্ধতির প্রতি সমর্থন দেন। তাঁরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একেকটি গুচ্ছের মধ্যে নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার নেওয়ার পক্ষে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আবেদন ফরম, খাতা ও পরিদর্শন ফি বাবদ যত টাকা খরচ হয়, তার কয়েক গুণ বেশি টাকা ভর্তি-ইচ্ছুকদের কাছ থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা রেখে তা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তা মানে না বা কম দেয় বলে অভিযোগ আছে।

গতবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমের মূল্য ছিল ৩০০ টাকা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ফরমের মূল্য কাছাকাছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফরম বাবদ আয় করেছিল প্রায় ৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা থেকে আয় করা অধিকাংশ টাকা ‘সম্মানীর নামে’ ভাগাভাগির অভিযোগ ওঠে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি করে এই বিশ্ববিদ্যালয় আয় করেছিল প্রায় ৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ আবুল খায়ের গতকালপ্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এ খাতের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেন, তবে সম্পূর্ণ দিতে পারেন না। এই অর্থ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করা হয় বলে জানান কোষাধ্যক্ষ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পুরো টাকা দেয় না বলে তাঁরাও অভিযোগ পেয়েছেন। তবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেয়। তাঁর মতে, স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষায় রাজি হয় না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কম থাকায় আলাদা পরীক্ষা হলেও খুব সমস্যা হতো না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তি করে। আরও দুটির কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় আছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, এটা কমানোর জন্যই গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সফল হওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি শিক্ষার্থীদের এই দুর্ভোগ উপলব্ধি করে এগিয়ে আসে, তাহলেই এটি সম্ভব বলে মত দেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি মো. আলাউদ্দিন বলেন, আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে মেডিকেলের পাঠ্যক্রম একই ধরনের হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুষদ ও বিভাগগুলোর পাঠ্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে। তাই সমন্বয়ের কাজটি কঠিন। তবে তা অসম্ভব নয় বলেও মত দেন তিনি।

ইউজিসির একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনেও বর্তমান ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ, ব্যয়বহুল ও কোচিংনির্ভর বলে উল্লেখ করা হয়। ইউজিসির উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের এক গবেষণায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়—এ তিনটি গুচ্ছ করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ২০০৮ সাল থেকে আলোচনার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উপাচার্যদের সভায় বেশির ভাগ উপাচার্য সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেন। এরপরও এ নিয়ে আরও কয়েক দফা আলোচনা হয়। গত বছর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত সেটিও কার্যকর হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান প্রথমআলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের দুর্ভোগ লাঘব ও খরচ কমাতে আমরাই সরকারকে গুচ্ছ ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহযোগিতা করলে এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হতো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *