চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’

Slider জাতীয় বিনোদন ও মিডিয়া

13775866_781900845280466_6981944383522014541_n
তিনি বলেছিলেন, চান্নি পসর রাইতে যেন তার মৃত্যু হয়। না, নিয়তি তার কথা শোনেনি, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এক সকালে ঘুমের ভেতরে তার মৃত্যু হয়। তিনি হুমায়ূন আহমেদ, বাংলা সাহিত্যের অতুল কথাকার; আজ তার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ৬৪ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ক্ষণজন্মা এই কথাসাহিত্যিক। অসামান্য সাহিত্যকীর্তি, আশ্চর্যসুন্দর রচনাবলি আর জীবনকে আনন্দময় করে দেখার প্রবণতায় হুমায়ূন আহমেদ চিরায়ত হয়ে আছেন বাঙালি পাঠকের হৃদয়জুড়ে।

গল্প, উপন্যাস, নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা, সঙ্গীত রচনা, চিত্রাঙ্কনসহ শিল্প-সাহিত্যের অনেক ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সাহিত্যের যে ক্ষেত্রে পদচিহ্ন এঁকেছেন, সাফল্যের দেখা পেয়েছেন তার সবক’টিতে। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও বটে। চার দশকের বেশি সময় ধরে পাঠককে মোহগ্রস্ত করে রেখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ তার জাদুকরি লেখনীর মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’র মধ্য দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে যাত্রা শুরু হয় তার। সেই যাত্রা ছিল বাংলা সাহিত্যের পালাবদলের তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত। একে একে প্রকাশিত হওয়া তার পরবর্তী উপন্যাসগুলো পাঠকপ্রিয়তার উত্তুঙ্গে অবস্থান করে। আমৃত্যু সেই জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাটার টান পড়েনি।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। সাহিত্যে উৎসাহী বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন তিনি। মা আয়েশা ফয়েজ ছিলেন গৃহিণী।

১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। দুই দশক পর তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে পূর্ণাঙ্গ যুক্ত হন।

হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমি গতকাল নিয়ে বাঁচি না। আগামীকাল কী হবে, আমার মৃত্যুর পর আমার লেখা কে পড়ল-কে পড়ল না, তা নিয়েও আমি ভাবি না। আমি আমার নিজের মতো করে লিখে যাচ্ছি। প্রবল আনন্দ নিয়েই লিখছি। জীবনটাও খুব আনন্দের সঙ্গেই কাটাতে চাইছি। এবং আমি সুখী। কারণ আমি জানি, কীভাবে সুখ খুঁজে নিতে হয়।’ জীবনের সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন বলেই হয়তো ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে প্রথম দফা চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এতটা হাসিমুখে অকপট বিদায় নিতে পেরেছিলেন তিনি।

২০১২ সালের আজকের দিনে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় হুমায়ূন আহমেদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিউইয়র্ক থেকে ২৩ জুলাই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে লাখো মানুষের অশ্রু-পুষ্পে শেষবারের মতো ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। পরের দিন তিনি সমাহিত হন তার গড়ে তোলা নন্দনকানন নুহাশপল্লীর লিচুতলায়।

১৯৭৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ বিয়ে করেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানকে। হুমায়ূন ও গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলেমেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। ২০০৫ সালে তাদের ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে। এর পর হুমায়ূন আহমেদ বিয়ে করেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে। এ দম্পতির দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে হলো- ‘নন্দিত নরকে’, ‘লীলাবতী’, ‘কবি’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘দূরে কোথায়’, ‘সৌরভ’, ‘ফেরা’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘সাজঘর’, ‘বাসর’, ‘গৌরীপুর জংশন’, ‘নৃপতি’, ‘অমানুষ’, ‘বহুব্রীহি’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘শুভ্র’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’, ‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ প্রভৃতি। তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালের একুশে বইমেলায়। রচনা ও পরিচালনা করেছেন বহু একক ও ধারাবাহিক নাটক। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ তার ইতিহাস নির্মাণকারী নাটক। পরিচালনা করেছেন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও।

পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো হলো- ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ ও ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, এবং সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য তিনি লাভ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্যজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার অন্যতম। দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। জাপানের এনএইচকে টেলিভিশন তাকে নিয়ে ‘হু ইজ হু ইন এশিয়া’ শিরোনামে ১৫ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র প্রচার করে।

মৃত্যুর পরও হুমায়ূন আহমেদ চিরকালীন হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যজগতে। ৩৬০টি গ্রন্থ আর নুহাশপল্লীর অবারিত সবুজের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ সবার প্রিয় হিসেবেই বেঁচে থাকবেন।

কর্মসূচি: গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকীতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত নুহাশপল্লী হুমায়ূন-সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন।  সে সঙ্গে স্থানীয় কয়েকটি এতিমখানার ছাত্রদের নিয়ে কবর জিয়ারত, কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। সে সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় খাবার পরিবেশন করা হবে এতিম শিশুদের মধ্যে।

হুমায়ূন আহমেদের পৈতৃক বাড়ি কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামে দিনমান নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। তার নিজ হাতে গড়া বিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী এসব কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের ছাত্রছাত্রীদের কোরআন খতম, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা অনুষ্ঠান।

হুমায়ূন-ভক্তদের সংগঠন হিমু পরিবহনের আয়োজনে সারাদেশে থাকছে ক্যান্সার সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, সেমিনার, রক্তদান কর্মসূচি, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সারাদেশে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণ, হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী।

হুমায়ূন-প্রয়াণ দিবসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিকেল সাড়ে ৩টায় প্রচারিত হবে ‘শিল্পকথা’র বিশেষ পর্ব। রাজু আলীমের গ্রন্থনা, উপস্থাপনা ও পরিচালনায় এ অনুষ্ঠানে থাকছে হুমায়ূন স্মৃতিচারণ এবং তার নাটক ও চলচ্চিত্রের গান। চ্যানেল আইয়ে রাত সাড়ে ৯টায় থাকছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আনন্দ-বেদনার কাব্য’। রাজু আলীমের গ্রন্থনা ও পরিচালনায় এ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী।

এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে রূপান্তরিত নাটক ‘নদ্দিউ নতিম’ প্রদর্শিত হবে আজ সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। নাটকটি প্রদর্শন করবে ম্যাড থেটার। রূপান্তর ও নির্দেশনা দিয়েছেন আসাদুল ইসলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *