নেপথ্যে কারা

Slider জাতীয়

 

 

untitled-6_217326

 

 

 

 

 

গত ১৮ মাসে দেশে উগ্রপন্থিদের ৪৭টি হামলায় ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী জঙ্গি হামলায় গ্রেফতার করা হয় ১৪৪ জনকে। যদিও আটক হওয়া আসামির মধ্যে অধিকাংশই সন্দেহভাজন। জঙ্গি হামলায় জড়িত মূল আসামিদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারছে না। কিছু ঘটনায় অপারেশনে অংশ নেওয়া জঙ্গিরা গ্রেফতার হলেও তাদের নেপথ্যে কারা রয়েছেন তা অজানা থাকছে। কারা উগ্রপন্থিদের মদদ ও অর্থ দিচ্ছেন তার শেকড় সন্ধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। এমনকি উগ্রপন্থিদের মধ্যে ‘প্রতিশোধমূলক’ হামলার প্রবণতাও বাড়ছে। পুুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন উগ্রপন্থি নিহত হলে পরবর্তী সময়ে তার পাল্টা ‘অপারেশন’ দেখা যায়। তবে চট্টগ্রামে এসপিপত্নী নিহত হওয়ার পর সোমবার থেকে উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে রয়েছে পুলিশ।
যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে জঙ্গিরা হামলা করছে, তারা গ্রেফতার না হওয়ায় এসব নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গুপ্ত হামলার পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির মদদ রয়েছে। এর পেছনে কেউ কেউ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর জড়িত থাকার কথাও বলছেন। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ষড়যন্ত্রের কথাও বলা হচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যারা এর আগে প্রকাশ্যে মানুষ পুড়িয়েছে, এখন কৌশল পাল্টে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, এসব ঘটনার নেপথ্যে বিএনপি- জামায়াত রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, গুপ্তহত্যার পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র যুক্ত। জেএমবি, এবিটি, জামায়াত-শিবির আলাদা কিছু নয়। যারা জেএমবি-এবিটি; তারাই
জামায়াত-শিবির।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, উগ্রপন্থিদের দমনে দুইভাবে কাজ চলছে। মাঠ পর্যায়ে যারা অপারেশনে অংশ নিচ্ছেন তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি অর্থ ও মদদদাতাদের খোঁজা হচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু ঘটনায় এমন কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে যারা এক সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হামলায় জড়িতদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাদের একটি অংশ এক সময় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত এবিটি ও জেএমবির সঙ্গে এরই মধ্যে জামায়াত-শিবিরের কিছু নেতাকর্মীর যোগসূত্র পাওয়া গেছে। এমনকি কেউ কেউ আগে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন পুরোপুরি উগ্রপন্থিদের দলে ভিড়েছেন। গাবতলীতে পুলিশ চেকপোস্টে এএসআই ইব্রাহিম হত্যায় জড়িত এনামুল একসময় বগুড়ায় শিবিরের নেতা ছিলেন। পল্লবীতে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত তারেক হোসেন মিলু ওরফে ওসমান জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে শিবির নেতা ছিলেন। এর আগে ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আবদুল্লাহ গাজীপুরের শিবির কর্মী। এ ছাড়া বর্তমানে যারা জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অনেকে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে অপারেশনে অংশ নিচ্ছেন। বগুড়ায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত তরিকুল ২০০৫ সালে জেএমবির হামলার পর আটক হন। এরপর কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার উগ্রপন্থিদের দলে ভেড়েন।

উগ্রপন্থি নেটওয়ার্কে চাকরিচ্যুত শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রবাসী কিছু বাঙালির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বান্দরবানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সাহায্যের নামে শামীম আহমেদ নামে এক ব্যক্তি জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা করেন। সেখানে তিনি ‘ম্যানরিং ম্যারং’ নামে একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। বেসরকারি ব্যাংকের একটি হিসাব নম্বরে কুয়েত থেকে শামীমের নামে মোটা অঙ্কের টাকা আসে। শামীম নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ অব বাংলাদেশ-এর (হুজিবি) সঙ্গে জড়িত। একইভাবে ফেনীর এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে; যার নামে কুয়েত থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আসে। এছাড়া কুষ্টিয়ার হুজিবির নেতা সাজ্জাদুল আলম সংগঠনের জন্য চাঁদা তুলে সারাদেশের কর্মীদের মধ্যে বণ্টন করেন। এমনকি হুজিবির শীর্ষ নেতা কারাবন্দি মুফতি হান্নানের ছেলেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হচ্ছে সংগঠন থেকে তোলা চাঁদার টাকায়। গত বছরের ডিসেম্বরে আসা ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা মূল্যের আরেকটি চালান জঙ্গিদের হাতে পেঁৗছার আগেই গোয়েন্দারা তা জানতে পারেন। এরপরই ওই চালানটি জব্দ করে সোনালী ব্যাংকে মামলার আলামত হিসেবে জব্দ রাখে ডিবি। এসব আলামত বলছে, উগ্রপন্থিদের অর্থায়নের উৎস অনেক বিস্তৃত।

পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গুপ্তহত্যার ঘটনায় সারাদেশে ১৪৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসব ঘটনায় পিস্তল উদ্ধার করা হয় ১৫টি, এসএমজি ১টি, একে-২২ রাইফেল ২টি, গুলি ৪৬১ রাউন্ড, হ্যান্ডগ্রেনেড ৯১টি, তাজা বোমা ১৬টি, চাপাতি ১৬টি, মোটরসাইকেল ১০টি, ল্যাপটপ ২টি ও ক্যামেরা ৩টি। তবে এসব ঘটনার নেপথ্যের শক্তি চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা যায়নি।

উগ্রপন্থিদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা  জানান, মূলত বাংলাদেশের উগ্রপন্থিরা চারটি ধাপে অপারেশন পরিচালনা করে। প্রথম ধাপে থাকেন অর্থদাতা ও পরামর্শদাতা, দ্বিতীয় ধাপে প্রশিক্ষক, তৃতীয় ধাপে থাকেন যারা টার্গেট নির্বাচন করেন আর সর্বশেষ ধাপে থাকেন যারা সরাসরি হামলায় অংশ নেন। প্রতিটি ধাপে পৃথক পৃথক সেল রয়েছে। যা এবিটির কাছে ‘স্লিপার’ নামে পরিচিত। তবে জেএমবিরও আলাদা সেল আছে। এখন পর্যন্ত গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে_ এবিটিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ৪-৫ ব্যক্তি।

তাদের মধ্যে আছেন মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল হক জিয়া, তামিম, শরিফুল ও আরও দুই যুবক। তবে এরই মধ্যে জেএমবির দুর্ধর্ষ সামরিক কমান্ডার ঢাকা অঞ্চলের সমন্বয়ক আলবানী ওরফে হোজ্জা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। অনেক ঘটনায় কোনো কোনো সামরিক কমান্ডার হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন। তবে উগ্রপন্থিদের পরামর্শদাতা ও অর্থদাতাদের ব্যাপারে কিছু তথ্য থাকলেও জড়িত সকলকে এখনও আইনের আওতায় আনা যায়নি। তবে জেএমবি ও এবিটি বিদেশ থেকে অর্থ পাচ্ছে এমন তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে। এমনকি পাকিস্তানি একটি গোয়েন্দা সংস্থা জাল টাকা ও ডলার ব্যবসার মাধ্যমে বাংলাদেশি উগ্রপন্থিদের আর্থিক সহায়তা করছে। এ ছাড়া রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও হত্যার পর তদন্তে এমন কয়েকটি হিসাব নম্বরের খোঁজ পাওয়া গেছে, তা ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক। ওই হিসাবধারী ব্যক্তিদের আয়ের সঙ্গে অ্যাকাউন্টে জমা থাকার অর্থের বিশাল গরমিল ছিল।

গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র মতে, জেএমবি ও এবিটিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ভেতর থেকে কেউ কেউ মদদ দিচ্ছে। জেএমবি ও এবিটির মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে পুনরায় দেশব্যাপী উগ্রপন্থি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। গোয়েন্দারা মনে করছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা একের পর এক উগ্রপন্থি হামলা করছেন, একটি অপশক্তি তাদের ধর্মের ভুল ব্যাখা দিয়ে ‘ব্যবহার’ করছেন। যারা এর নেপথ্যে রয়েছেন তাদের মূল্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক আর অভিন্ন। দেশকে অস্থিতিশীল করে ভুল বার্তা দেওয়ার তাদের প্রধান লক্ষ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *