শনাক্ত হয়নি খুনিরা

Slider জাতীয়

 

untitled-2_216897

 

 

 

 

 

চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারের স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যার দু’দিন পার হলেও শনাক্ত করা যায়নি খুনিদের। সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ অস্পষ্ট থাকায় খুনিদের ব্যাপারে অন্ধকারে পুলিশ। খুনিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে সন্দেহভাজন চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি উদ্ধার হলেও সেটির মালিককে পাওয়া যায়নি। উদ্ধার করা যায়নি নিহত মাহমুদা খানম মিতুর মোবাইল ফোনটিও। এ ফোনেই খুনিরা ভুয়া খুদে বার্তা পাঠিয়ে মিতুকে নির্ধারিত সময়ের আগেই ঘর থেকে বের করে এনেছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এদিকে, গতকাল সোমবার খুনের ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার।
সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার গতকাল দুপুরে  বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করছি। বাবুল আক্তার এর আগে যেসব অপরাধীকে গ্রেফতার করেছেন, তারা কেউ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কি-না কিংবা কারাগারে বসে এর পরিকল্পনা করেছে কি-না, তাও তদন্ত করছি।’ তিনি আরও বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে যাদের অবয়ব আছে, তাদের ছবি আরও স্পষ্ট করার জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। নগরীর অন্যান্য স্পটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সংগ্রহ করা হচ্ছে। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘খুনের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত তিন ব্যক্তিসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি গভীরতর তদন্তের স্বার্থে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে।’

মিতুর মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠাল কে?: নিহত মিতুর মোবাইলটি উদ্ধার করতে না পারায় অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা তদন্তকারীদের কাছে। মোবাইল ফোনটিতে গত শনিবার রাতে মিতুর ছেলে মাহিরের স্কুল থেকে খুদে বার্তা দেওয়া হয়। প্রতিবেশী কয়েকজন নারী জানান, মিতু শনিবার রাতে তাদের সঙ্গে আলাপের সময় বলেছিলেন, স্কুল থেকে খুদে বার্তা দিয়েছে, রোববার স্কুলে সমাবেশ আছে, তাই স্কুলবাস তাড়াতাড়ি আসবে। তবে এ ব্যাপারে মাহিরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের অধ্যক্ষ কর্নেল আবু নাসের মো. তোহা জানান, স্কুল থেকে কোনো খুদে বার্তা পাঠানো হয়নি। এ প্রসঙ্গে সিএমপি কমিশনার বলেন, ‘মোবাইল পাওয়া গেলে হয়তো ব্যাপারটি জানা যাবে।’ চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে বাবুল আক্তার জঙ্গি দমন অভিযানে সাহসিকতার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। তবে বিভিন্নভাবে হুমকি আসতে থাকায় উদ্বিগ্ন ছিলেন তারা। ওআর নিজাম রোডের ওই বাসা বদলে ফেলার ইচ্ছার কথাও এক প্রতিবেশীকে বলেছিলেন মিতু।

মোটরসাইকেলটির মালিকের খোঁজে গোয়েন্দারা: সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার মোকতার হোসেন সমকালকে বলেন, ‘সোমবার ভোর ৩টার দিকে পাঁচলাইশ থানার বাদুড়তলা বড় গ্যারেজ এলাকায় ওই মোটরসাইকেলটি পাওয়া যায়। মোটরসাইকেলটিতে চট্ট মেট্রো ল ১২-৯৮০৭ নম্বরপ্লেট থাকলেও তা ভুয়া। আমরা এর মালিককে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি।’ গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, মোটরসাইকেলটি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল। ওই এলাকার পাহারাদার পুলিশকে জানালে পুলিশ এটি উদ্ধার করে। পাহারাদার পুলিশকে জানান, কে বা কারা মোটরসাইকেলটি রোববার সকালে রেখে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন, এর মালিক হয়তো পরে নিয়ে যাবে। তবে সারাদিনেও কেউ না নেওয়ায় সন্দেহ হয়। তার পর টিভিতে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে হত্যায় মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়েছিল শুনে তিনি পুলিশকে জানান। এদিকে গোয়েন্দাদের তথ্যমতে, মোটরসাইকেলটির মালিক ২০১১ সালে এটি বিক্রি করে দেন। তবে কার কাছে বিক্রয় করা হয় বা কে এই মালিক, তারই উত্তর খুঁজছে গোয়েন্দারা। পুলিশ কমিশনারের দাবি, ‘আমরা এরই মধ্যে মোটরসাইকেলের মালিকের নাম-পরিচয় পেয়েছি। তার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে যে সে আসল মালিক কি-না।’

মোটরসাইকেলে পাওয়া গেল চুল: গতকাল সকালে দুই ঘণ্টা ধরে মোটরসাইকেলটি পর্যবেক্ষণ করে সিআইডির ক্রাইম সিন টিম। তারা মোটরসাইকেলে একটি হেলমেট ও একটি মাস্ক পান। এ ছাড়া মোটরসাইকেল থেকে পাওয়া যায় তিনটি চুল। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য এরই মধ্যে চুল সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে বলে জানান সিআইডির পরিদর্শক মিতোশ্রী বড়ূয়া। তিনি আরও বলেন, ‘মোটরসাইকেল থেকে আরও অনেক আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আলামতগুলো পরীক্ষা করে মোটরসাইকেলের ব্যবহারকারীদের ব্যাপারে জানা যাবে।’

সন্দেহের তলিকায় শিবিরও: মিতু হত্যায় জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশসহ সব জঙ্গি সংগঠনের পাশাপাশি ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররাও জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। জামায়াত-শিবির অধু্যুষিত শুলকবহর এলাকা থেকে মোটরসাইকেলটি উদ্ধারের পর এবং বাবুল আক্তারের অতীতের জঙ্গি ও নাশকতাবিরোধী অভিযান বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এ সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। সিএমপি কমিশনার  বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে তথ্য আছে, দুর্বৃত্তরা খুনের পর গোলপাহাড় মোড়, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর, বাদুড়তলা দিয়ে পালিয়ে গেছে। এই পুরো এলাকা জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত। এ জন্য এ ঘটনার সঙ্গে শিবিরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সন্দেহ করছি। তিনি আরও বলেন, ‘শিবিরের যারা প্রাক্তন নেতাকর্মী, তারাই জেএমবিসহ নানা জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলেছে। যারা জেএমবি করে, তাদের একটি বড় অংশই বর্তমান কিংবা প্রাক্তন শিবির। এ কারণেই হত্যাকাণ্ডে জেএমবির সঙ্গে শিবিরও জড়িত ছিল কি-না, খতিয়ে দেখছি।’

তদন্ত প্রসঙ্গে পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য: তদন্তে আজ মঙ্গলবারের মধ্যে বড় অগ্রগতি হবে বলে আশা করছেন সিএমপি কমিশনার। গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য চারজনকে আনা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রয়োজন হলে তাদের আটক দেখানো হবে।’ চারজনের পরিচয় কী, তাদের কোথা থেকে কখন ধরা হয়েছে, সে তথ্য প্রকাশ করেননি পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা যাবে না। পরে প্রয়োজন হলে আটক দেখিয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হবে।’ পুলিশ কমিশনার বলেন, মূলত গোয়েন্দা পুলিশ অন্য সব বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে। এ হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে জেএমবির সংশ্লিষ্টতাকে প্রাধান্য দিয়ে সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে পরে ওই চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ক্ষোভে ফুঁসছে বন্দরনগরী: পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছে চট্টগ্রাম। তাৎক্ষণিকভাবে অনেকেই ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ মিছিলও হয় রোববার। এদিকে, গতকাল বেলা ১১টার দিকে মানববন্ধন করেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের শিক্ষার্থীরা। কলেজ দুটির সামনে মানববন্ধনে মিতুর খুনিদের গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার কর্মীরা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে একই দাবি জানান। মিতু হত্যার প্রতিবাদে সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হবে আগামীকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে। এ মানববন্ধনের উদ্যোক্তা সাংস্কৃতিক সংগঠক ডা. চন্দন দাশ বলেন, ‘বাবুল আক্তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে জীবনবাজি রেখে একের পর এক সফল অপারেশন করেছেন। এ জন্যই তার স্ত্রী টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন। আমরা রাজপথে মানববন্ধন করব সৎ-সাহসী পুলিশ অফিসারদের মনোবল অটুট রাখতে। তারা যাতে উপলব্ধি করতে পারেন, সাধারণ মানুষ তাদের পাশে আছে, থাকবে।’

গত রোববার সকালে নগরীর ওআর নিজাম রোডের বাসা থেকে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে জিইসি মোড়ে যাওয়ার সময় খুন হন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। তাকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে জঙ্গি কায়দায় হত্যা করা হয়।

বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা: চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ও নাটোরে খ্রিস্টান দোকানিকে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। পৃথক বার্তায় এসব সংগঠন ক্ষোভ, নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানায়। এ ধরনের হামলা ও হত্যার ঘটনার পুনরাবৃত্তিরোধে দ্রুত পরিপূর্ণ এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানায় এসব সংগঠন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *