সর্বনাশা ক্রিকেট জুয়া

Slider জাতীয়
untitled-1_215164
ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের গায়ে জুয়ার কলঙ্ক লেগেছে অনেক আগেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘আশার ফুল’খ্যাত আশরাফুলও পেয়েছেন নিষেধাজ্ঞার সাজা; কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে সর্বনাশা জুয়া এখন আর খেলোয়াড় ও বাজিকরে সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। যদিও পুলিশের দাবি- এ ব্যাপারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরেজমিন চিত্র বলছে, দিন দিন বাড়ছে জুয়া। কেউ কেউ কোটিপতি হলেও এর ফাঁদে পড়ে হাজারো মানুষ হয়েছেন নিঃস্ব।

রাজধানীর সর্বত্র চলছে ক্রিকেট জুয়া। তবে পুরান ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রমরমা। খেলা যেখানেই হোক, টিভিতে সম্প্রচার মানেই জুয়ার মোক্ষম সুযোগ। ওয়ানডেতে যেমন, টি২০ হলে তো কথাই নেই! গত টি২০ বিশ্বকাপ ও চলমান আইপিএলে পুরান ঢাকার গলিগলিতে চলেছে জুয়া। পুরান ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজ এলাকার আবদুর রকিব জানালেন, রোজ সন্ধ্যায় তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার, বংশালসহ সব এলাকায়ই দোকানে দোকানে অনেক লোক একসঙ্গে টিভিতে খেলা দেখে। আসলে সবই জুয়ার আসর। তার মারফত এক জুয়াড়ির সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, এ খেলায় ছাত্র, বেকার, ব্যবসায়ী সবাই জড়িত। এক হাজার থেকে ১০ লাখ সব অঙ্কের জুয়া হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়েও জুয়া হয়। আবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জুয়া কেনাবেচাও হয়। তিনি দ্বিতীয়টির সঙ্গে জড়িত।

কেন এতে জড়ালেন? এ প্রশ্নে এ জুয়াড়ি জানালেন, মুহূর্তে টাকা দ্বিগুণ করার লোভ কে সামলাতে পারে! এ লোভেই নিঃস্ব হচ্ছে তরুণরা। সুদে টাকা ধার করে জুয়ায় নামার নজিরও আছে। তেমনই একটি নজির পাওয়া গেল প্রত্যন্ত গ্রাম নরসংদীর পলাশের ডাঙ্গায়। এই গ্রামের ছেলে এইচএসসির শিক্ষার্থী রাকিব। তার মামা জানালেন, ক্রিকেট-জুয়ার নেশায় পড়ে তার ভাগিনা এখন গ্রামছাড়া। একই গ্রামের জহিরুল নামের এক সুদখোর মহাজনের কাছ থেকে ১ লাখ ৩ হাজার টাকা ধার করে আইপিএল জুয়ায় নেমেছিল ১৮ বছর বয়সী রাকিব। হেরে যাওয়ায় টাকা ফেরত দিতে পারেনি। এখন আর গ্রামে ফিরতে পারছে না।

ক্রিকেট-জুয়া কতটা ছড়িয়েছে, তা টের পাওয়া গেল ময়মনসিংহে। গত ২৩ মে শহরের জয়নুল আবেদিন পার্কে কথা হয় স্বাধীন নামে ঢাকার উত্তরা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রের সঙ্গে। তিনি জানান, আগের রাতে চলমান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে (আইপিএল) হায়দরাবাদ সানরাইজার্স ও কলকাতা নাইট রাইডার্সের খেলা নিয়ে বাজি ধরে তিনি হেরেছেন ৬৪ হাজার টাকা। এবারের আইপিএলে এ নিয়ে তিনি হেরেছেন প্রায় ৩ লাখ টাকা।

স্বাধীন জানান, শুধু তিনি নন, ময়মনসিংহের হাজারো মানুষ এ জুয়ায় জড়িত। ময়মনসিংহে ক্রিকেটের এ জুয়া ‘ইস্টুু’ নামে পরিচিত। কথা বলতে বলতেই স্বাধীনকে মোবাইল ফোনে ব্যাঙ্গালুরু রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ও গুজরাট লায়ন্সের খেলায় জুয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ফোনেই সমান সমান দরে ১০টি বাজি অর্থাৎ ১০ হাজার টাকা জুয়ায় লাগান তিনি। স্বাধীন জানালেন, শুধু আইপিএল নয়, বিপিএল, পিসিএল সব ধরনের ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ নিয়েই জুয়া হয়। তবে ওয়ানডের চেয়ে টি২০ নিয়েই জুয়া হয় বেশি। ছাত্রাবস্থায় কেন এমন সর্বনাশা কাজে জড়ালেন- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাধীন জানান, বড় ভাইরা ‘ইস্টু’ খেলেন। দেখে দেখে তিনিও জড়িয়ে গেলেন। এখন নেশা হয়ে গেছে, তাই পড়াশোনা বাদ দিয়ে ময়মনসিংহে বসে আছেন।

স্বাধীনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পার্কের বিভিন্ন চায়ের দোকানে আড্ডারত তরুণদের কথাও কানে আসে। প্রায় প্রত্যেকেরই আলাপের বিষয়বস্তু আগের রাতের খেলায় কে কত টাকা জিতেছে, আর কে কত হেরেছে। এর মধ্যেই আগামী দিনের খেলার জুয়ার দরদামও ঠিক হচ্ছে।

স্বাধীন জানালেন, ব্যাঙ্গালুরু ও গুজরাটের খেলার দর সমান। অর্থাৎ এক হাজার টাকা জুয়ায় জিতলে দুই হাজার টাকা পাওয়া যাবে। যদিও দু’দিন আগে পাঞ্জাব ও পুনের খেলার দর ছিল ১০ :১৫। অর্থাৎ পুনের পক্ষে যারা এক হাজার টাকা বাজি ধরেছিলেন, তারা আড়াই হাজার টাকা পেয়েছেন। এই জুয়া নিয়ন্ত্রণ করে তৃতীয় পক্ষ। তার কাছেই দু’পক্ষের জুয়ার টাকা জমা থাকে। যে পক্ষই জিতুক তৃতীয় পক্ষ বাজির টাকার একটা অংশ পেয়ে যায়। এমনকি এ খেলা নিয়ে এক জেলার মানুষ অন্য জেলার কারও সঙ্গেও বাজি ধরেন। আর টাকা লেনদেন হয় বিকাশে। দায়-দায়িত্ব সেই তৃতীয় পক্ষের।

জানা গেছে, ময়মনসিংহের জব্বার আলী কমপ্লেক্স ও মেছুয়া বাজার এ জুয়ার অন্যতম আখড়া। সন্ধ্যার পরই এখানে ভিড় জমে সব বয়সী জুয়াড়ির। এ ছাড়া মেডিকেল কলেজ গেটের বিপরীতে ছোট দোকানগুলোতেও চলে রমরমা জুয়া। জুয়াড়িরা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। তাদেরই একজন সামাদ। তিনি জানান, আইপিএল, বিপিএল, পিসিএল- সব খেলাতেই তারা বাজি ধরেন। ইট-বালুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সামাদ কেন এ নেশায় জড়ালেন তার উত্তরে জানান, প্রতিদিনই কেউ না কেউ লাখ টাকা জিতছেন। তাই দ্রুত বড়লোক হওয়ার নেশায় জুয়ায় নাম লিখিয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম বলেন, ‘জুয়ার যেসব আখড়া ছিল, তা তিন বছর আগেই বন্ধ করে দিয়েছি। শহরে তাসের জুয়াও খেলা হয়। ক্রিকেটের জুয়া হয় মোবাইল ফোনে। তা পুলিশের পক্ষে জানা কঠিন। তবে কেউ যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয়, তাহলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’

প্রতিনিধিরা জানান, সারাদেশেই হচ্ছে এমন জুয়া। যশোর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রা?হ্মণবাড়িয়া- সব জায়গা থেকেই খবর এসেছে ক্রিকেট-জুয়ার। যশোরে জুয়াড়িদের টাকা ধার দেন স্থানীয় সুদখোর মহাজনরা। এ জুয়ার ফাঁদে পড়েই যশোরের এককালের জুয়েলার্স মালিক সমীর এখন পথের ফকির। একইভাবে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি বাবুল মোদক ভিটেমাটি সব হারিয়েছেন। নীলফামারীর ডোমারের গ্রামের দোকানগুলোতে এলইডি টেলিভিশনে সন্ধ্যার পর চলে খেলা দেখা। একই সঙ্গে চলে জুয়া।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ক্রিকেট-জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে সজাগ রয়েছে পুলিশ। এর আগে মিরপুর থেকে একজন পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। সাধারণত খেলা চলার সময় বিশেষ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তার পরও কোথাও এ ধরনের ঘটনার আভাস বা তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট থানা বা পুলিশের যে কোনো শাখাকে জানানোর অনুরোধ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *