পপুলিস্টের এনারকি আদালত অবমাননা ও রাষ্ট্রদ্রোহীতা র অপরাধ

Slider ফুলজান বিবির বাংলা বাংলার আদালত বাধ ভাঙ্গা মত সম্পাদকীয় সারাদেশ

14842_f2

 

 

তিনি একজন শিক্ষক। শিক্ষাগুরু। নাম তার শ্যামল কান্তি ভক্ত। কয়েক দশক ধরে তিনি জ্ঞান বিতরণ করেন কিশোর-কিশোরীদের। ঘটনাক্রমে তিনি আবার ‘সংখ্যালঘু’। শিক্ষকের সংখ্যালঘু হওয়াটা অপরাধ নয়। বাংলাদেশের পাঠশালা, স্কুল এমনকী মাদ্রাসায়ও হিন্দু শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেনি এমন শিক্ষিত মানুষ পাওয়া দুষ্কর। হয়তো ক্বওমী মাদ্রাসাই ব্যতিক্রম। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শিক্ষার্থীদের মারধর করেছেন। ভর্ৎসনা করেছেন। ধর্মানুভূতিতেও আঘাত করেছেন বলে অভিযোগ।

২০১১ সালে হাইকোর্ট শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়াকে বেআইনি এবং অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্রও জারি করে। তাতে বলা হয়, ‘হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টার জাতীয় বস্তু ছুঁড়ে মারা, আছাড় দেওয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেওয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেওয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা ওঠ-বস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নীচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাটু গেড়ে দাঁড় করে রাখা, রোদে দাঁড় করে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে শ্রমআইনে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করানো যাবে না’। পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

অভিযোগের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’ সুতরাং, শ্যামল কান্তি তার ছাত্রছাত্রীকে এমন শাস্তি দিয়ে থাকলে অবশ্যই আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী। সেজন্য, সরকারি কর্মচারী বিধিমালার (১৯৮৫) আওতায় ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথবা, ফৌজদারি আইনের আওতায় ব্যবস্থা নিতে পারে বিচারবিভাগ। বিচারবিভাগের কাজ হল বিচার করা। সেটি যদি সংসদ সদস্য করতে যান তা হবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সীমালঙ্ঘন।

এবার আসা যাক ধর্মনুভূতির প্রশ্নে। ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারা মতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্র করা, ২৯৫ (ক) ধারায় ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমাননা করা, ২৯৬ ধারায় ধর্মীয় সমাবেশে গোলমাল সৃষ্টি, ২৯৭ ধারায় সমাধিস্থানে অনধিকার প্রবেশ এবং ২৯৮ ধারা অনুযায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। বিদ্যমান দ-বিধিতে এসব বিষয় অপরাধ বলে গণ্য করা হলেও শাস্তির পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান ছিল। এখন তা সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধানসহ অর্থদণ্ড নির্দিষ্ট করে দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন ২০১৩ সালে আইনমন্ত্রী ব্যরিস্টার শফিক আহমেদ। সুতরাং, প্রচলিত অইন অনুসারে ধর্মনুভূতিতে আঘাতের ঘটনারও বিচারের সুযোগ আছে। তাহলে শ্যামলকান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার পথে যাওয়া হল না কেন? স্থানীয় এমপি নিজেই জনগণের সামনে বিচারকের ভূমিকায় হাজির হলেন কেন? উপস্থিত জনতার সামনে ‘হিরো’ হওয়ার উদ্দেশ্যেই কি? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় সস্তা জনপ্রিয়তার এই পথকে বলা হয়, ‘পপুলিজম’। একজন এমপির পপুলিস্ট ভূমিকা আজ গোটা দেশকে ফের ভাগ করেছে দুই ভাগে। তার সেই ভূমিকা আজ আইনের শাসনের বিপরীতে সংখ্যালঘু বনাম সংখ্যাগুরুর বিতর্কে লিপ্ত করেছে আমাদেরকে। আইন প্রণেতাই আইনের স্বাভাবিক ভূমিকাকে পাশ কাটিয়েছেন। বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা রাখার পরামর্শ তিনি দিতে পারেননি উপস্থিত জনতাকে। আমাদের দেশে ‘গণধোলাই’র সংস্কৃতি আছে। এমপি সেই সংস্কৃতিরই পক্ষপাতিত্ব করেছেন।

আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ – আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ। সংসদ সদস্য হলেন আইন বিভাগের একজন সদস্য। তিনি আইনপ্রণেতা; আইন প্রণয়ন করা তার কাজ। সেই আইনের ভিত্তিতে বিচারের কাজ তার নয়। যখন তিনি তা করেন তখন রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র থাকে না। তা অরাজকতার দিকে ধাবিত হয়। বিচারহীনতার দিকে ধাবিত হয়। যাকে বলে ‘এনারকি’। আর এই এনারকি একদিকে যেমন বিচারবিভাগের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট সৃষ্টির চেষ্টা । অন্যদিকে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্টের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে  বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ও সম্মান নষ্ট করার অপরাধ যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল।

ড. এ কে এম রিপন আনসারী

এডিটর ইনচীফ

গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *