১৯৫ পাকিস্তানি সেনার বিচার দাবি জোরালো হচ্ছে

Slider রাজনীতি
pak-soldier_212571
যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর এবার একাত্তরে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ১৯৫ পাকিস্তানি সেনাসদস্যের বিচারের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তদন্তে গণহত্যায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ১৯৭৪ সালে বিচারের শর্তে তাদের পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সিমলা চুক্তির দোহাই দিয়ে ৪২ বছরেও বিচার করেনি পাকিস্তান। আইনজ্ঞরা মনে করেন, গণহত্যাকারী ওই সব কর্মকর্তার বিচার করা সম্ভব। এতে আইনি বাধা নেই। সিমলা চুক্তিতে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি।

যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকরে পাকিস্তানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি দলের নেতারা বলেছেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের সহায়তায় ১৯৫ সেনার বিচার করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একাধিক সংগঠনও একই দাবি করে আসছে। চিহ্নিত এসব যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে আগাম তথ্য সংগ্রহ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। যুদ্ধাপরাধীদের মামলার তদন্তকালে তাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেগুলো সংরক্ষণ করতে তদন্ত সংস্থার পাঁচ সদস্যের একটি দল গত জানুয়ারি থেকে কাজ করছে।

জানা গেছে, সরকারের সিদ্ধান্তের পর বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা ভিনদেশি নাগরিক হওয়ায় তাদের বিচার করতে অন্যান্য দেশের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অনুমোদন প্রয়োজন। এ কারণেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রাখছে তদন্ত সংস্থা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানি সেনাদের বিচার করতে অবশ্যই বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনতে হবে। বিশ্বকে জানাতে হবে, মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে কী ভয়াবহ অপরাধ করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। স্বাধীনতার পর এসব পাকিস্তানি সেনার বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ। চিহ্নিত করা হয়েছিল শীর্ষ অপরাধীদের। কিন্তু নানা বাস্তবতার কারণে বিচারিক উদ্যোগ থেমে যায়। এখন কেন তাদের বিচার করতে হবে, তার যৌক্তিকতাও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে হবে।

জানা গেছে, গণহত্যার মূল হোতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজিসহ আট সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধের স্থান-কাল উল্লেখ করে অভিযোগনামা স্বাধীনতার পরপরই তৈরি করা হয়। এতে দেখা যায়, নিয়াজি গণহত্যার পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের জন্য ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বৈঠক ডাকেন এবং তাতে অংশ নেন। তার অধীনে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণেরও প্রমাণ পাওয়া যায়।

এমনকি নিজের মনোরঞ্জনের জন্য অন্তত ৫০ জন নারীকে আটক রাখার অভিযোগ কুখ্যাত নিয়াজির বিরুদ্ধে। ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘটনায় নিয়াজির উপস্থিত থাকারও প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। নিয়াজির বিরুদ্ধে আগ্রাসন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের জন্য ষড়যন্ত্র, আদেশ দেওয়া, ধর্ষণ এবং সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল হোসেন আনসারি, কর্নেল ইয়াকুব মালিক, কর্নেল শামস, মেজর আবদুল্লাহ খান, মেজর খুরশিদ ওমর ও ক্যাপ্টেন আবদুল ওয়াহিদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের এ দেশীয় সহযোগীদের বিচারে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাকিস্তান। আর সেনানায়কদের বিচারের মুখোমুখি করলে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় মেতে উঠবে কি পাকিস্তান? এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, এ নিয়ে মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই। এরই মধ্যে কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বিদ্যমান আইনেই যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সম্ভব। ১৯৭৩ সালে আইনটি করা হয়েছিল মূলত যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য।

জীবিত বা মৃতদের তালিকা নেই: তবে পাকিস্তানে অভিযুক্ত ১৯৫ জনের বিচার মানতে নারাজ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এর সংখ্যা আরও বেশি। প্রকৃতভাবে হিসাব করে যতজন জীবিত আছে, তাদের সবাইকে বিচার করতে হবে।

জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক  বলেন, পাকিস্তানি ১৯৫ জনের মধ্যে কতজন জীবিত আছে, সেটা জানা নেই। কে জীবিত আছে আর কে মারা গেছে, এসব বিষয়েও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি জানান, তথ্য ও নথি সংগ্রহ করতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি থেকে ওই কমিটি কাজ করছে, যা অব্যাহত আছে।

বিচারে বাধা নেই: পাকিস্তানি ১৯৫ সেনা কর্মকর্তাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হলেও বিচারে কোনো আইনগত বাধা নেই বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যেহেতু ত্রিদেশীয় চুক্তিটি সংসদে পাস হয়নি, সে কারণে এ চুক্তির আইনগত ভিত্তি নেই। চুক্তি স্বাক্ষরকারী ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বলেছেন, ঘটনার এত বছর পরও বিচার করা সম্ভব গণহত্যাকারীদের।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ  বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিচার করা সম্ভব। তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করা যেতে পারে। সিমলা চুক্তির পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার করেছিলেন, ১৯৫ জনের বিচার করা হবে। সে ওয়াদা রক্ষা করেনি পাকিস্তান সরকার। সঠিক তথ্য নিয়ে তাদের বিচার করা উচিত।

আওয়ামী লীগের সভাপতিম লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, সিমলা চুক্তি করে ১৯৫ সেনাসদস্যের বিচার হওয়ার কথা ছিল; পাকিস্তান করেনি। দরকার হলে জাতিসংঘের সহায়তা নিয়ে সেই ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী সেনাসদস্যের বিচার করা হবে। শুক্রবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে দেশটি কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানতে চাইবে বাংলাদেশ সরকার। তিনি বলেন, পাকিস্তান বারবার ১৯৭৪ সালের চুক্তি নিয়ে ভুল তথ্য দিচ্ছে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, ১৯৫ জন বলে কোনো কথা নেই। জীবিত এবং যাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ১৯৫ জনের তালিকা সঠিক নয়। সম্প্রতি তদন্ত সংস্থার কাছে ৩৬৯ যুদ্ধবন্দির তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে।

বিচার শুরু করার দাবিতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বিবৃতি :চিহ্নিত ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১। গতকাল সংগঠনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম, ভাইস চেয়ারম্যান লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী ও মহাসচিব হারুন হাবীব এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান।

বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সব আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পাকিস্তান বারবার হস্তক্ষেপ করছে। পাকিস্তান যদি এই ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিও জানানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *