নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

Slider টপ নিউজ

117617_392

 

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাত ১২টা ১০মিনিটে রায় কার্যকর করা হয়।

এর আগে রাতেই পরিবারের সদস্যরা মাওলানা নিজামীর সাথে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেষ দেখা করেছেন। দণ্ড কার্যকরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশ কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয় সূত্র।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সব প্রস্তুতি চলছে। মাওলানা নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাইলে যেকোনো সময় দণ্ড কার্যকর করা হবে।

কারা সূত্র জানায়, দণ্ড কার্যকর উপলক্ষে সকালে কারা অভ্যন্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাত ৮টা ১০ মিনিটে সাংবাদিকদের জানান, মাওলানা নিজামী ক্ষমার আবেদন করেননি। তাই দণ্ড কার্যকরের নির্বাহী আদেশ কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

দণ্ড কার্যকর উপলক্ষে কারাগার এলাকায় সন্ধ্যা ৭টা থেকে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। কারাগারের সামনের রাস্তাসহ আশপাশের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিপুলসংখ্যক র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে কারাগার চত্বরে।

এ দিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জল্লাদ রাজুকে মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। কারারক্ষীদের প্রহরায় প্রিজন ভ্যানে রাজুকে কারাগারের ভেতরে নেয়া হয়েছে।

মাওলানা নিজামীর পারিবারিক সূত্র জানায়, সাড়ে ৬টার দিকে কারা কর্তৃপক্ষ ফোনে তাদেরকে মাওলানা নিজামীর সাথে দেখা করার জন্য খবর দেয়। রাত ৭টা ৫০ মিনিটে পরিবারের সদস্যরা কারাগারের সামনে পৌঁছেন। এর কিছুক্ষণ পর মাওলানা নিজামীর পরিবারের সদস্য এবং নিকটাত্মীয় মিলে ২৪ জনকে কারা অভ্যন্তরে নিয়ে যায় কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী, দুই ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন ও ডা: নাইমুর রহমান খালেদ, দুই মেয়ে মহসিনা ফাতেমা ও খাদিজা আক্তার, দুই ছেলের স্ত্রী ও তাদের তিন সন্তান। শেষ সাক্ষাৎ শেষে রাত সাড়ে ৯টায় তারা কারা অভ্যন্তর থেকে বের হয়ে আসেন।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর উপলক্ষে মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজধানীজুড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়।

গত সোমবার দুপুরে রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে। বিকেলে আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মেহেদি হাসান রায়ের কপি নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাত ৭টার দিকে ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার কেশব রায়ের নেতৃত্বে পাঁচ কর্মকর্তা রায়ের লিখিত কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেন। লাল ফাইলে মোড়ানো রায়টি গ্রহণ করেন কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির। রাতেই মাওলানা নিজামীকে রায় পড়ে শোনানো হয়।

আগের দিন রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাওলানা নিজামীকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।

গত ৫ মে মামলার সর্বশেষ ধাপে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর দায়ের করা রিভিউ (পুনরায় বিবেচনা) আবেদন খারিজ করে দেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এর আগে আপিল বিভাগ যে রায় দেয় তা বহাল থাকে।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বেলা ১১টায় রিভিউ আবেদন খারিজ করে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।

মাওলানা নিজামীকে ২০১০ সালের জুনে গ্রেফতারের প্রায় ছয় বছরের মাথায় তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় দেয়া হয়।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মাওলানা নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নির্দেশদাতা, পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র এবং ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়ে (সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি) মাওলানা নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে মাওলানা নিজামী তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। আলবদর বাহিনী একটি অপরাধী সংগঠন এবং এ বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যায় মাওলানা নিজামীর নৈতিক সমর্থন ছিল। ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ এবং বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে এসব সংগঠনের সদস্যদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল। কাজেই ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের দায় তিনি এড়াতে পারেন না।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আটটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে।

এর মধ্যে চারটি অভিযোগের প্রতিটিতে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য চারটি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

গত ৬ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রায় দেন। আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডের তিনটি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দু’টি দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়। গত ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ১৫ দিনের মধ্যে আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন মাওলানা নিজামীর পক্ষে তার আইনজীবীরা। গত ৩ মে রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ সংক্রান্ত মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য উসকানি, পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র এবং বৃদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় ২০১২ সালের ২৮ মে।

২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমাণ ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল; কিন্তু রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বদল হওয়ায় পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন করা হয় এবং ২০১৪ সালের ২৪ মার্চ দ্বিতীয় দফায় মামলার রায় অপেক্ষমাণ ঘোষণা করা হয়।

২০১৪ সালের ২৪ জুন মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছিল। মাওলানা নিজামী অসুস্থ থাকায় তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে না পারায় ওই দিন রায় ঘোষণা থেকে বিরত থাকে ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৬৭ জন সাক্ষীর তালিকা দেয়। এখান থেকে ২৬ জনকে হাজির করে তারা। অন্য দিকে আসামিপক্ষ ১০ হাজার ১১১ জন সাক্ষীর তালিকা দেয়। আসামিপক্ষে চারজন সাক্ষী নির্ধারণ করে দেয় ট্রাইব্যুনাল এবং তারা চারজন সাক্ষী হাজির করে।

চার সদস্যের আপিল বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

সংক্ষিপ্ত জীবনী
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মনমতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম লুৎফর রহমান খান।

স্থানীয় বোয়ালমারি মাদরাসা থেকে ১৯৫৯ সালে আলিম পরীক্ষায় তিনি মাদরাসা বোর্ডে ষোলতম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬১ সালে ফাজিল এবং ১৯৬৩ ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাস করেন তিনি। কামিল পরীক্ষায় ফিকাহ শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তিনি তিনবার পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান ইসলামী জমিয়তে তালাবার (ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

মাওলানা নিজামী ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জামায়াতের ঢাকা মহানগর শাখার আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮৮ সালে সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পান। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির নির্বাচিত হন।

মাওলানা নিজামী পাবনা-১ (সাঁথিয়া-বেড়া) আসন থেকে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সংসদ সংসদ্য নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের কৃষি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চার ছেলে ও দুই কন্যাসন্তানের বাবা।

মাওলানা নিজামীর পক্ষে এ মামলায় ট্রাইব্যুনালে আইনজীবী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনসারী, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন, তারিকুল ইসলাম, আসাদ উদ্দিন প্রমুখ। সুপ্রিম কোর্টে মাওলানা নিজামীর পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন ও অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর হায়দার আলী, প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন এ মামলায়। অন্য দিকে আপিল বিভাগে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *