মরুভূমির কবরে বাংলাদেশিদের নির্ঘুম রাত

Slider সারাবিশ্ব

10611_f1

 

 

 

 

 

 

ধু-ধু মরুভূমি। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় মাটি খোঁড়ার বেলচা। বলা হয় কবরের মতো করে গর্ত খুঁড়তে। এরই মধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়। এক-একটি গর্তে নামিয়ে দেয়া হয় ৫-৭ জন করে। এরপর ছোট্ট একটা মুখ খোলা রেখে দেয়া হয় বালিচাপা। সকাল হলেই সেই গর্ত থেকে উঠে আবারও লিবিয়ার পথে যাত্রা। সুদান ও লিবিয়ার মধ্যবর্তী মরুভূমিতে এভাবেই দিনের পর দিন কাটে পাচারের শিকার হওয়া মানুষের। চলে দালালদের অমানুষিক নির্যাতন। সম্প্রতি পাচারের শিকার হওয়া ৩০ বাংলাদেশি এই অসহনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। মরুভূমিতে এভাবেই ১০ দিন কেটেছে তাদের। শেষ পর্যন্ত নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান ঠিকই। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তখন শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এই সময়ে তাদের ওপর চলেছে শারীরিক নির্যাতন। দু-একদিন পরপর যে খাবার দেয়া হয়েছে তা খুবই সীমিত। অবৈধভাবে দেশটিতে প্রবেশ করায় এদের অনেকেই প্রকাশ্যে চিকিৎসাও নিতে পারেন না। অনেকেই পালিয়ে বেড়ান এখানে-সেখানে। এদের মধ্যে ৪ জন দেশে ফিরেছেন সম্প্রতি। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, নতুন এই রুটটি মানবপাচারকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদিকে মানবপাচারের এই রুট নিয়ে সতর্কতামূলক পোস্ট দেয়া হয়েছে লিবিয়ার বাংলাদেশি দূতাবাসের অফিসিয়াল পেইজে।

সম্প্রতি লিবিয়ার যুদ্ধাবস্থার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সুযোগে দেশি-বিদেশি দালাল সিন্ডিকেট অবৈধভাবে দেশটিতে লোক পাঠাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তৈরি করেছে মানবপাচারের নতুন রুট। বাংলাদেশ থেকে সুদান হয়ে লিবিয়া। এই পথে লিবিয়া পৌঁছতে সময় লাগছে ১৫ দিন থেকে এক মাস। আর দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এছাড়া প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে মুক্তিপণও আদায় করছে তারা।

সূত্র জানিয়েছেন, গত বছরের জানুয়ারি মাসে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ৯ জন, ফরিদপুরের ২ জন, কুমিল্লার ৫ জন, সিলেটের ৯ জনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই বিদেশ যাওয়ার জন্য ঢাকার পল্টনের একটি ঠিকানায় যোগাযোগ করেন। সেই অফিসের বিপ্লব নামে এক ব্যক্তি তাদের বনানীর সানলাইট নামে একটি এজেন্সির মালিক আনিসের কাছে নিয়ে যান। তবে বায়রার সদস্যের তালিকায় এই নামে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি নেই। কথিত সেই অফিস থেকে জানানো হয়, লিবিয়া থেকে জরুরি কিছু ভিসা এসেছে। জনপ্রতি আড়াই লাখ টাকা খরচ হবে। এর কয়েকদিন পর ভুক্তভোগীদের ডেকে আবারো বলা হয় লিবিয়া থেকে জরুরি ভিসা এসেছে। ৪ লাখ টাকা করে দিলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে লিবিয়া যাওয়া যাবে। এই প্রলোভনে দেশের বিভিন্ন এলাকার ৩০ জন প্রত্যেকে পল্টনের অফিসে গিয়ে বিপ্লব ও আনিসের হাতে ৪ লাখ টাকা করে দেয়। এরপর তড়িঘড়ি করে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে গত ২৮শে জানুয়ারি বিমানে তুলে দেয়া হয়। তাদের নামানো হয় সুদানের একটি বিমানবন্দরে। সেখানে তাদের রিসিভ করে বনানীর এজেন্সীর মালিক আনিসের ছোট ভাই সুমন, শাহীনসহ ৫ বাংলাদেশি। তারা তাদেরকে দেশটির এক নির্জন এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে প্রত্যেকের কাছে আরো এক লাখ টাকা দাবি করে। ১ লাখ টাকা দিলে লিবিয়া পাঠানো হবে, অন্যথায় সুদানে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়। গোডাউনে আটকে রেখে তাদের ওপর চলে শারীরিক নির্যাতন। এ সময় দিনে একবেলা রুটি খেতে দেয়া হতো। এভাবে ১৫ দিন যাওয়ার পর দেশে মুক্তিপণের টাকা পাওয়া নিশ্চিত হলে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে একটি এসি বাসে তুলে দেয়। কিন্তু বাসটি প্রায় ২ কিলোমিটার যাওয়ার পর সবাইকে নামিয়ে দেয়। চালক জানায়, ১ ঘণ্টার বাস ভাড়া করা হয়েছে। এরপর এই ৩০ জনের সঙ্গে থাকা দুই দালাল দুটি ছোট পিকআপ ভ্যান নিয়ে আসে। এর একটিতে সবাইকে গাদাগাদি করে উঠানো হয়, অন্যটিতে নেয়া হয় ব্যাগসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। এর কিছুক্ষণ পর দালালচক্রে আরো দুই বিদেশি যোগ দেয়। সন্ধ্যার আগে তাদের একটি মরুভূমিতে নামিয়ে দেয়া হয়। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে দালালরা গাড়িতে ঘুমালেও তাদের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাদের হাতে বেলচা দিয়ে সেখানে কবরের মতো করে গর্ত খুঁড়তে বলে। না খুঁড়লে চলে বেধড়ক মারপিট। এরপর প্রত্যেকটা গর্তে ৫-৭ জন করে নামিয়ে ছোট একটা মুখ খোলা রেখে বালিচাপা দেয়া হয়। রাত কাটে এভাবেই। সকাল হলে সেখান থেকে উঠিয়ে আবার যাত্রা শুরু হয় লিবিয়ার উদ্দেশ্যে। এ সময় তাদের খেতে দেয়া হয় কবজা নামের এক ধরনের রুটি। তাও এক-দু’দিন পরপর। পানি চাইলে বালিতে ফেলে মারধর করতো। এভাবে ১০ দিন ১০ রাত কেটে যায় লিবিয়া আর সুদানের মধ্যবর্তী মরুভূমিতে। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি এই ৩০ বাংলাদেশি লিবিয়ার আজদাবিয়া সীমান্তে পৌঁছে। সেখানে পৌঁছে জানতে পারে সুদানের দালালচক্র তাদেরকে লিবিয়ার বাংলাদেশি দালালদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। লিবিয়ার আজদাবিয়া সীমান্তে কামরুল, নাসির, কামাল, আনোয়ারসহ ৫ জন দালালের হাতে তুলে দেয়া হয় তাদের। এই দালালরাও তাদের লিবিয়ার একটি গোডাউনে নিয়ে আটকে রেখে প্রত্যেকের কাছে ১ লাখ টাকা করে দাবি করে। অপারগতা জানালে চোখ-হাত-পা বেঁধে চলে নির্যাতন। তারা আবার পরিবারের কাছে ফোন করে। ৫০ হাজার টাকায় সমঝোতা হলে প্রত্যেকের পরিবার ওই টাকা বিকাশ করে দেয়। পরে সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ২৫শে ফেব্রুয়ারি একটি গাড়িতে করে ত্রিপোলির উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেয় তাদের। বিষয়টি জানাজানি হলে মেরে ফেলারও হুমকি দেয় দালালরা। এই ৩০ জন ত্রিপোলিতে এসে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন। কিছু বাংলাদেশি তাদের আশ্রয় দেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় গোপনে চিকিৎসা নেয় অসুস্থ হয়ে পড়া বাংলাদেশিরা। এই ৩০ বাংলাদেশির মধ্যে সিলেটের কানাইঘাটের ৪ জন আশ্রয় নেয় দেশটির একটি দোকানে কর্মরত সুনামগঞ্জের হুমায়ুনের কাছে। হুমায়ুন জানান, আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছিল বলে কয়েকদিন পর তারা দেশে ফিরে গেছেন।

এদিকে গত ১১ই এপ্রিল লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক লিবিয়ায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ করে একটি পোস্ট দেয়া হয়েছে। এতে মানবপাচারের নতুন এ রুটের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘কতিপয় অসাধুচক্র লিবিয়ার বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে অবৈধভাবে বাংলাদেশি কর্মীদের লিবিয়ায় প্রেরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা কর্মীদেরকে প্রথমে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে দুবাই-শারজাহ-কায়রো-আম্মান হয়ে লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ সুদানে প্রেরণ করে। পরবর্তীতে তাদেরকে সুদানের স্থলসীমান্ত হয়ে দুর্গম মরুভূমি পাড়ি দিয়ে লিবিয়ায় অনুপ্রবেশ করানো হয়। পথিমধ্যে কষ্টসাধ্য ২০-২৫ দিনের দীর্ঘযাত্রায় দুর্গম মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়ে খাদ্য ও পানির অভাবে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। তাদেরকে মৃত্যুর পর রীতিসিদ্ধভাবে দাফন করারও সুযোগও থাকে না। এরূপ প্রক্রিয়ায় অবৈধ অভিবাসনের ক্ষেত্রে আগত কর্মীরা সুদান ও লিবিয়ায় একাধিক মানবপাচারকারীচক্রের নিকট বিক্রি ও অপহৃত হয় এবং বাংলাদেশে তাদের পরিবারের নিকট মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণ না পেলে তাদেরকে অনাহারে রেখে মারধর করা হয়। সমপ্রতি এরূপ কয়েকটি ঘটনা দূতাবাসের নিকট উন্মোচিত হয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *