বিবিয়ানার গ্যাস সঞ্চালন লাইনে নাশকতার পরিকল্পনা উলফার

Slider অর্থ ও বাণিজ্য
untitled-6_205874
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র সিলেটের বিবিয়ানার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে নাশকতা চালানোর হুমকি দিয়েছেন ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) একাংশের নেতা পরেশ বড়ূয়া। গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে এ হুমকির খবর জানতে পারে বাংলাদেশ সরকার। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের পরিচালনায় রয়েছে এ ক্ষেত্রটি। বর্তমানে সারাদেশে যে গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে, তার ৪৫ ভাগই তোলা হয় এ ক্ষেত্র থেকে। হুমকির এ খবর পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। সরকারি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে এ খবর জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল  বলেন, তিনি বিষয়টি এখনও অবহিত হননি। তবে পরেশ বড়ূয়ার এ হুমকির বিষয়ে সার্বিক তথ্য-উপাত্তের সরকারি নথি সমকালের হাতে রয়েছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কোনো কারণে এই ক্ষেত্রটি থেকে একদিন গ্যাস তোলা বন্ধ থাকলে গোটা দেশের বিদ্যুৎসহ শিল্প-কলকারখানা অচল হয়ে পড়বে। ফলে এ রকম হুমকি পাওয়ার পর অতীব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে তাৎক্ষণিকভাবে বিবিয়ানাসহ আশপাশ এলাকায় পাইপলাইনের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সম্প্রতি পরেশ বড়ূয়া এবং উলফার ২০৯ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডার দৃষ্টি

রাজখোয়াকের মধ্যে টেলিফোন ও মোবাইল ফোনে আলাপ-আলোচনা হয়। সেটি রেকর্ড করে ভারতের আসাম রাজ্য পুলিশ ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো

(সিবিআই)কমান্ডারকে। উলফা এর আগে উত্তর-পূর্ব ভারতে গ্যাস পাইপলাইনে একাধিকবার হামলা চালিয়েছে। টেলিফোনের এই কথোপকথন ভারত সরকার জানার পর তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করে। এর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৭ মার্চ এক চিঠিতে এ হুমকির বিষয়ে কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইসতিয়াক আহমদ গত ৩০ মার্চ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীকে লেখা এক চিঠিতে এ হুমকির বিষয়টি তুলে ধরেন। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, শেভরনের পরিচালনাধীন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র, এর আশপাশের পাইপলাইন এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঞ্চালন ও বিতরণ পাইপলাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শেভরন ও জিটিসিএলকে (গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড) অনুরোধ করা হয়েছে। বিবিয়ানার এই গ্যাস পাইপলাইন হবিগঞ্জ জেলার মুচাই পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে শেভরনের একটি গ্যাস কমপ্রেশার স্থাপনাও রয়েছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমেই বিবিয়ানার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আসে। এর পর তা সারাদেশে বিভিন্ন প্রান্তে পেঁৗছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বিবিয়ানা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র। মাত্র এই একটি ক্ষেত্র থেকেই সারাদেশে প্রতিদিন উৎপাদনের ৪৫ শতাংশ তোলা হয়। উলফার হুমকির কারণে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে মর্মে দ্রুত কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এ চিঠি পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১০ এপ্রিল মহাপুলিশ পরিদর্শক ও বিজিবির মহাপরিচালককে একটি চিঠি দেয়। সেখানে পরেশ বড়ূয়ার এ হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কিন কোম্পানি শেভরনের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এখানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পরিচালনাধীন স্থাপনার নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। নিরাপত্তা ইস্যুতে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে কাজ করি এবং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

প্রাপ্ত তথ্যে বাংলাদেশের ওপর পরেশ বড়ূয়ার ক্ষোভের কারণ সম্পর্কে সংক্ষেপে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে সিইউএফএল জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশেষ আদালত ২০১৪ সালে পরেশ বড়ূয়াকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এ ছাড়া সম্প্রতি শেরপুর জেলায় র‌্যাবের অপারেশনে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও দলিল-দস্তাবেজ উদ্ধার হয়। ধারণা করা হয়, এগুলো ছিল পরেশ বড়ূয়ার অনুচরদের। এসব কারণে পরেশ বড়ূয়া প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক তৎপরতা চালানোর পরিকল্পনা করে আসছেন।

পরেশ বড়ূয়া এখন কোথায় :অনেক আগে উলফার সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন পরেশ বড়ূয়া। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বর্তমানে তিনি চীন-মিয়ানমার সীমান্তের কোথাও লুকিয়ে আছেন বলে ধারণা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে লুকিয়ে থাকা উলফা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর পরেশ বড়ূয়া চীন-মিয়ানমার সীমান্তের তেনচং ও রুই-এর মধ্যবর্তী কোথাও পালিয়ে যান বলে জানা যায়।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন পরেশ বড়ূয়া। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের একটি আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০০৯ সালের শেষ দিকে উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়াসহ সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাকে বাংলাদেশ থেকে আটক করে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০১০ সাল থেকে দিলি্লতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উলফার শান্তি আলোচনা চলছে। গত বছরের ১১ নভেম্বর ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয় উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে। তিনি ১৮ বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে ছিলেন। বর্তমানে তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পরেশ বড়ূয়ার নেতৃত্বাধীন উলফার অপর অংশ এ আলোচনার ঘোর বিরোধী। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

পরেশ বড়ূয়ার নেতৃত্বে উলফা ২০১৫ সালের শুরুর দিকে ভারতের আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে একজোট হয়ে ভারতের সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর ওপর কয়েক দফা হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। প্রতিক্রিয়ায় ওই বছরের জুলাইয়ে মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে ঢুকে উলফার ঘাঁটিতে বেশ কয়েক দফা হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু পরেশ বড়ূয়াকে ধরা সম্ভব হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *