প্রথম পোস্টমর্টেমে ধর্ষণের আলামত নেই

Slider গ্রাম বাংলা নারী ও শিশু

8573_f3

 

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে। হত্যার আগে তনুকে ধর্ষণের আলামত মিলেনি বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, তনুর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কেও কিছু বলা হয়নি এ রিপোর্টে। এমনকি সুরতহালে মাথায় আঘাতের কথা উল্লেখ করা হলেও ময়নাতদন্তে কোনো আঘাত পাওয়া যায়নি। এই প্রতিবেদনকে রহস্যময় মনে করছেন নিহত সোহাগী জাহান তনুর স্বজনরা। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক শারমিন সুলতানা জেসমিন গতকাল তনুর লাশের প্রথমদফা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা দেন বিভাগীয় প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহার কাছে। এ বিষয়ে ডা. কামদা প্রসাদ সাহা মানবজমিনকে জানান, ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কান ও নাক রক্তাক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন পোকামাকড়ের কামড়ে তা সামান্য রক্তাক্ত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের মৃত্যুর কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে তিনি আরও জানান, কী কারণে তনুর মৃত্যু হয়েছে ময়নাতদন্তকারী  চিকিৎসক শারমিন সুলতানা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে বিষক্রিয়ায় তনুর মৃত্যু হয়নি বলে ভিসেরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তনুর লাশের সুরতহালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, তার মাথার পেছনে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু ময়নাতদন্তে মাথায় কোনো আঘাতের চিহ্ন পাননি চিকিৎসক। প্রথমদফা এই ময়নাতদন্তে কোনো ত্রুটি ছিলো না দাবি করে কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, যিনি ময়নাতদন্ত করেছেন তিনি একজন অভিজ্ঞ ও ভালো চিকিৎসক।
তনুর পিতা ইয়ার হোসেন জানান, তনুর লাশ যখন উদ্ধার করেন তখন তার জামার নিচের ডান ও বাম দিকে ছেঁড়া ছিলো। বুকের উপরের দিকেও ছেঁড়া ছিলো। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশের উপ-পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বুকের দিকে জামা ছেঁড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেননি। মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সুরতহাল থেকে শুরু করে প্রথম দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন কিছুই সঠিকভাবে হয়নি। যে কারণে অধিকতর তদন্তের স্বার্থে পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেন মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি’র পরিদর্শক মঞ্জুর আলম। আদালতের নির্দেশে ৩০শে মার্চ তনুর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রসঙ্গে সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, প্রথম দফা ময়নাতদন্তে ত্রুটি রয়েছে বলেই পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়েছে।
তনুর মৃত্যুর পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে তার লাশ ও আলামত গ্রহণ করে পুলিশ। ওই সময়ে সিএমএইচের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত প্রসূতি  বিশেষজ্ঞ ডা. লে. কর্নেল সেলিনা বেগমের উপস্থিতিতে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ। গত রোববার এ বিষয়ে লে. কর্নেল সেলিনা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডির তদন্তকারী দল। ঘটনাস্থল থেকে লাশ সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া ও আলামত সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট সেনাবাহিনীর একজন ওয়ারেন্ট অফিসার, দুইজন সার্জেন্ট, একজন কর্পোরাল ও এক সেনাসদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এছাড়াও পিয়াল ওরফে পিয়ার ও রাব্বী নামে দুই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এদিকে, একজন সেনা কর্মকর্তার ছেলে পিয়াল ও কুমিল্লা সরকারি কলেজের ছাত্র রাব্বীকে এর আগে পৃথকভাবে ডিবি ও র‌্যাব জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানা গেছে। রাব্বীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিলো তনুর। পিয়ালের বিরুদ্ধে তনুকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ রয়েছে।
গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত সেনানিবাস এলাকার ঘটনাস্থল ও তনুদের বাসা পরিদর্শন করেছেন পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর সদস্যরা। এসময় তারা তনুর পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলা তদন্তের কোনো অগ্রগতি আছে বলে মনে করেন না তনুর পিতা ইয়ার হোসেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। সবাই শুধু আমাদের জিজ্ঞাসা করে। মনে হয় যেন আমরাই আসামি। আসামি কারা এখনও শনাক্ত করতে পারেননি তারা। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে তিনি বলেন, তনুর মাথার পেছনে আঘাত ছিলো। ময়নাতদন্তে এগুলো কেন উল্লেখ করা হবে না। এটা রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২০শে মার্চ রাত সাড়ে ১০টার পরে কুমিল্লা সেনানিবাসের অলিপুরের কালো ট্যাংকি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় তনুর লাশ। নিহত তনু ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেনের তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা। তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। পরিবারের সঙ্গে থাকতেন সেনানিবাস এলাকায়।
ছাত্র ধর্মঘট: এদিকে তনু হত্যার বিচার দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের ডাকে গতকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়েছে। কর্মসূচি চলাকালে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি লাকী আক্তার বলেন, তনুর বিষয়ে আলামত নষ্ট করা হচ্ছে এবং এই ঘটনার দৃশ্যমান  যে অগ্রগতি, তা আমরা এখনও পাইনি। একজন শ্রমিক তিন দিন আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ ক্যান্টনমেন্টের মতো একটি জায়গায় এরকম একটি ঘটনার এতদিন পার হওয়ার পরও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। তনুর খুনিকে  গ্রেপ্তারের দাবিতে ৭ই এপ্রিল সারাদেশে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেবে ছাত্র ইউনিয়ন। ১০ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে নাগরিক সমাবেশ করবে তারা। লাকী আক্তার বলেন, সর্বাত্মকভাবেই স্কুল-কলেজগুলোতে ধর্মঘট সফল করতে পেরেছি। বিভিন্ন পাবলিক-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ধর্মঘটে সমর্থন জানিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দী ও ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক সুমন সেনগুপ্তসহ সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *