আওয়ামী লীগের জয়জয়কার মামলা-হয়রানি এড়াতে বিরোধীদের সমর্থন!

Slider ফুলজান বিবির বাংলা রাজনীতি সারাদেশ

7974_up-election

 

এবারের ইউপি নির্বাচনে অনেক স্থানে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এসেছে। মামলা, হয়রানি, নির্যাতন আর অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ ওই দল দুটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হার্ডলাইনে গিয়ে নির্বাচন না করে বরং ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই কাজ করেছে। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে এমনটিই জানা গেছে।

অন্যদিকে উত্তরবঙ্গে জাতীয় পার্টির দুর্গ দিনকে দিন নাজুক হয়ে পড়ছে। এ জনপদের ২২ জেলায় জাতীয় পার্টি এবার ভোটের হিসাবে তিন নম্বর, কোথাও কোথাও চার নম্বর দল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর বড় কারণ জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ওপর দলের নেতাকর্মীদের আস্থাহীনতা এবং একই সঙ্গে সরকারে আবার বিরোধী দলে থাকা। এসব কারণে এরশাদের নিজের জেলা রংপুরের একটি ইউনিয়নেও চেয়ারম্যান পদে জয় পায়নি জাতীয় পার্টি।

আর ওই তিন দলের এসব দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ঘরে সাফল্যের ফসল তুলেছে সরকারি দল। আওয়ামী লীগ নাজুক অবস্থানে আছে এ রকম এলাকাতেও এবার বড় বিজয় পেয়েছেন তাদের প্রার্থীরা। সামগ্রিকভাবে ভোটের ফলে এর প্রভাব পড়েছে। বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত বহু স্থানে সরকারি দলের প্রার্থীরা ৮০ ও ৯০ শতাংশের ওপরে ভোট পেয়েছেন। আর দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ইসির হিসাবে প্রাপ্ত মোট ভোটের ৫৪ শতাংশ আওয়ামী লীগ পেয়েছে আর বিএনপি পেয়েছে ২০ শতাংশ।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদের দৃষ্টিতে, গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াই বিপথগামী হয়ে গেছে। কোথাও জামায়াত, কোথাও বিএনপি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে। এখানে ‘ভিক্ষার দরকার নাই, কুকুর সামলান’-এর মতো পরিস্থিতি তাদের। তবে তারা হামলা-মামলার ভয়ে নাকি আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা তারাই ভালো বলতে পারবে।

গত ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির ভোটের হার ছিল ৫৪:১৭ শতাংশ। আর দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচন কমিশনের গত রাতে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য মতে, এ হার ৫৪:২০। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪৮:৩২ শতাংশ।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারেনি জামায়াত, তবে স্বতন্ত্রের হিসাবে বড় দুই দলের বিদ্রোহীদের পাশাপাশি জামায়াতও ছিল। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ৬৩৯টি ইউপি নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী বিজয়ী চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের ৪৪৪ জন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৩৪, বিএনপির ৫৯, জাপার ৪ ও স্বতন্ত্র ৫৭ জন। এই স্বতন্ত্রের মধ্যে কিছু জামায়াতও আছে বলে জানা গেছে।

নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লার মতে, দেরিতে হলেও জামায়াত বাস্তবতা অনুধাবন করেছে। এলাকাভেদে কোথাও নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে স্বতন্ত্র হিসেবে, কোথাও বিএনপির জন্য কাজ করেছে, কোথাও বা হয়তো আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জেতানোর জন্য কাজ করেছে। এটি তাদের নিরাপত্তা বা টিকে থাকার একটা কৌশল হতে পারে।

জামায়াতের আর্থিক ভিত্তি মজবুত, তা ছাড়া দলটি সাংগঠনিকভাবে যথেষ্ট সুসংহত। এখন প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার জন্য দলটি সুচতুরভাবে সুদূরপ্রসারী নানা কৌশল নেবে, এটাই স্বাভাবিক—বললেন ড. নাজমুল আহসান। ইউপি নির্বাচনের পরবর্তী ধাপগুলোতে তারা এ কৌশল অব্যাহত রাখবে বলেও তাঁর ধারণা।

নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১২১টি ইউপিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ৮০ শতাংশ আর ছয়টি ইউপিতে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। এসব ইউপির বহু এলাকাই রয়েছে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিছু কিছু রয়েছে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি।

জানা গেছে, বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, খুলনা, দিনাজপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কোথাও ৮০ শতাংশ, কোথাও ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়েছেন।

জামায়াতের এলাকা হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, খুলনার কিছু অংশ ও যশোরের কিছু ইউপিতেও ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে আওয়ামী লীগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত যেসব জেলা সেখানে দলটির কর্মীরা বিভিন্ন মামলায় ঘর ছাড়া। একটি বড় অংশ রয়েছে কারাগারে। ফলে এসব অঞ্চলে বিএনপির জন্য মাঠে নেমে ভোট চাওয়ার মতো কর্মীও ছিল না।

জানা গেছে, খালেদা জিয়াসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ১৫৮ নেতার বিরুদ্ধে চার হাজার ৩৩১টি মামলা রয়েছে। তবে সারা দেশে মামলার সংখ্যা আরো অনেক বেশি। বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ২২ হাজার মামলা রয়েছে। এসব মামলায় দলটির মাঠ পর্যায়ের চার লাখের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। আর বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার নেতাকর্মী। এসব মামলার বেশির ভাগই ২০১৩ ও ২০১৪ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় নাশকতার মামলা।

ইউপি নির্বাচনে সরকারি দলের বিপুল বিজয়ের পেছনে স্থানীয় পর্যায়ে ভয়ভীতি ও সমঝোতা কাজ করেছে কি না, এমন প্রশ্নে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতিতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অনেকেই হয়তো মনে করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের প্রকাশ্যে সমর্থন না করলে বিপদ হতে পারে। ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যও কোথাও কোথাও এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেলে বিজয় নিশ্চিত—এ ধারণাও কাজ করেছে। কারণ নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণ থেকেও এ রকম ধারণা পেয়েছে অন্যান্য দলের প্রার্থী ও সমর্থকরা।

কালের কণ্ঠের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি এম সাইফুল মাবুদ জানান, জেলার মহেশপুর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি জামায়াতের দখলে ছিল। এবারের নির্বাচনে এর চারটিই দখলে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। একমাত্র নাটিমা ইউনিয়ন জামায়াত তাদের দখলে রাখতে পেরেছে। উপজেলার আজমপুর ইউনিয়নে এবার উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের দখলে থাকা এ ইউনিয়ন এবার জামায়াত দখলে নিয়েছে।

উপজেলার জামায়াত অধ্যুষিত ইউনিয়নগুলোতে জামায়াতের বাক্সে ভোট না পড়ার কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে, জামায়াতের সাধারণ সমর্থকদের একটি অংশ তাদের নিজেদের পারিবারিক সামাজিক নিরাপত্তার কারণে এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আঁতাত করে বসবাস করছে। অনেকে হামলা-মামলার ভয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলছে। এবারের নির্বাচনে জামায়াতের একটি অংশ এলাকায় টিকে থাকার স্বার্থে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। এ ছাড়া মহেশপুর এলাকায় জামায়াত প্রভাবিত ইউনিয়নগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও তাঁর লোকজন জামায়াত সমর্থিত পরিবারগুলোকে যথেষ্ট চাপে রেখে ভোট আদায় করেছে। মহেশপুরের এক জামায়াত নেতা বলেন, ‘এলাকায় আমাদের যথেষ্ট কর্মী-সমর্থক আছে। তাদের দলে ধরে রাখার জন্যই নির্বাচনে আমরা প্রার্থী দিয়েছি। আমরা পাস করার জন্য নির্বাচন করিনি।’

রংপুর থেকে স্বপন চৌধুরী জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পৈতৃক ভিটা রংপুর এখন আওয়ামী লীগের দখলে। একসময়ের জাতীয় পার্টির দুর্গ ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের একটিতেও জিততে পারেননি জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা, যেখানে ১০টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বিভাগের আট জেলার ১০৫টির  মধ্যে জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে মাত্র তিনটিতে জয়লাভ করেছে। প্রথম ধাপে গত ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৫টি ইউনিয়নের একটিতেও জিততে পারেনি জাতীয় পার্টি।

এর আগে উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনেও দলটি ভালো করতে পারেনি। নিজেদের মধ্যে কোন্দল আর দলাদলির কারণে এমন ভরাডুবি হয়েছে বলে অনেকেই মনে করে। এ ছাড়া জাপাকে আর কেউ বিশ্বাস করতে চায় না, তাই এ ভরাডুবি। খোদ রংপুরে জাতীয় পার্টির অবস্থা এতটাই বেহাল যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য দলের কোনো নেতাকর্মীর আগ্রহ নেই। গত ২০ মার্চ দেশের ১০টি  পৌরসভায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌরসভায় জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী না থাকায় এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাকিবুর রহমান মাস্টার বিজয়ী হন। অথচ একসময় কাউনিয়া-পীরগাছা এলাকা ছিল জাপার নিশ্চিত আসন। এর আগে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এই বিভাগের আট জেলার ১৯টি পৌরসভা নির্বাচনে ছয়টিতে মেয়র প্রার্থী দিতে পারেনি জাতীয় পার্টি। বাকি ১৩টির মধ্যে শুধু কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী পৌরসভায় মেয়র নির্বাচিত হন আবদুর রহমান মিয়া। বদরগঞ্জ পৌরসভায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী লাতিফুল খাবির মাত্র ১৭০ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। ওই দলের পরাজিত অন্য প্রার্থীদেরও ছিল প্রায় একই অবস্থা। অথচ নব্বইয়ের দশকের পর থেকে রংপুর ছিল জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি। এ ছাড়া গত ২২ মার্চ রংপুর বিভাগের দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও রংপুর জেলার ১৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বেশির ভাগ ইউনিয়নে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকলেও একটিতেও তাঁরা জয়লাভ করতে পারেননি। একসময় বৃহত্তর রংপুরের ২২টি সংসদীয় আসনে জাতীয় পার্টির (জাপা) লাঙ্গল মার্কার জয়জয়কার হলেও ক্রমান্বয়ে সেই জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে।

জাতীয় পার্টির দুর্গের এমন পতন সম্পর্কে রংপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা মনে করেন দলে নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের ব্যবধান সৃষ্টি হওয়া। তিনি বলেন, ‘জাপা থেকে নির্বাচিত হয়েই নেতারা আর এলাকামুখী হন না, রাখেন না কর্মীদের খোঁজখবরও। এ কারণেই দিন দিন দলটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে।’ তবে তিনি বলেন, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় পার্টি এগিয়ে যাবে। আগামীতে পার্টি আরো ভালো করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

মেহেরপুর প্রতিনিধি ইয়াদুল মোমিন জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ধাপে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার চারটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটেছে যোগ্য প্রার্থী না থাকা ও জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায়।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি মাসুদ অরুণ বলেন, দারিয়াপুর এবং মহাজনপুর ইউনিয়নে খুব কম ভোটে তাদের প্রার্থীরা হেরেছেন।

মাসুদ অরুণ আরো বলেন, অন্যান্য ইউনিয়নে জামায়াতের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়াটা আগে থেকে হয়নি বলেও এমন হতে পারে। মাসুদ অরুণ বলেন, এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে জেলার বাকি উপজেলার ইউপিতে বুঝেশুনে তাঁর দল নির্বাচন করবে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *