খুলনা: বিপর্যয় যেন পিছু ছাড়ছে না সুন্দরবনের। তেলবাহী ট্যাংকার, কয়লাবাহী জাহাজ, সার-সিমেন্ট বোঝাই জাহাজ ডুবির ঘটনার পাশাপাশি একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ এ বনে। মানুষের আগ্রাসী থাবায় মরছে বাঘ-হরিণ। এতে দিন দিন একটু একটু করে বিলুপ্ত হচ্ছে বনের চিরসবুজ প্রকৃতি।
সবশেষ রোববার (২৭ মার্চ) সন্ধ্যায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় আগুন লাগে। এতে লতাগুল্ম প্রজাতির গাছ পুড়েছে।
পূর্ব সুন্দরবনের অরণ্যে গত ১৪ বছরে সরকারি-বেসরকারি হিসাবে ১৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও এর প্রতিকার ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে চিহ্নিত করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বার বার পুড়ছে সৌন্দর্য্যর লীলাভূমি সুন্দরবন।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালের ২২ মার্চ সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে কটকা অভয়ারণ্যে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পুড়ে ১ একর ছন বন। এরপর ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী ক্যাম্পের মাদ্রাসারছিলা এলাকার ৩ একর বন পুড়ে যায়। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর আড়ুয়াবেড় এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ৯ শতক ছন বন। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের অধীন কদলতেজী এলাকায় পুড়ে যায় আড়াই একর বন। এর পাঁচ দিন পর একই রেঞ্জের তুলাতলা এলাকায় পুড়ে যায় সাড়ে ৪ একর বন।
পরের বছর অর্থাৎ ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেকা এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় একর বনভূমি। মাত্র এক মাসেরও কম সময়ে ১১ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় ৫০ শতক বন। এর একদিন পর কলমতেজির টহলফাঁড়ির খুটাবাড়িয়া এলাকার দেড় একর, পহেলা মে নাংলীর পচাকুড়ালিয়া এলাকার ৫০ শতক, ৩ দিন পর ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে আড়াই একর বনভূমি পুড়ে যায়।
২০০৭ সালে সুন্দরবনে ৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১৫ জানুয়ারি শরণখোলার ডুমুরিয়া ক্যাম্প এলাকায় ৫ একর, ১৯ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকার ২ একর ও ২৮ মার্চ একই এলাকার ৮ একর বনভূমি পুড়ে যায়। ২০১০ সালের ২০ মার্চ ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী এলাকায় প্রায় ৫ একর বন পুড়ে যায়।
পরের বছর ২০১১ সালের মার্চ মাসে দুই দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ১ মার্চ নাংলী এলাকার ২ একর ও ৮ মার্চ একই এলাকার ২৫ নম্বর কমপার্টমেন্টে টানা ৩ দিনের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় সাড়ে ৩ একর বন পুড়ে যায়। ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ টানা ৩ দিনের অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বনভূমি।
সর্বশেষ রোববার (২৭ মার্চ) সন্ধ্যায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকার আগুন লাগে।
বিগত সময়ের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্টে জেলে ও বনজীবীদের দায়ী করা হলেও তাদের চিহ্নিত করা বা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজির নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জেলে ও বনজীবীরা জড়িত থাকলেও অনেক সময় সুন্দরবনের অসাধু কর্তাব্যক্তিরাও জড়িত থাকেন। এসব অসাধু কর্তাব্যক্তিরা কাঠ, হরিণ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণী পাচারকারীরা, দেশি ও আর্ন্তজাতিক চোরাকারবারীদের পণ্যের নিরাপদ রুট ব্যবহারের জন্য অন্যত্র দৃষ্টি ফেরাতে পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। আবার অনেকেরই ধারণা সুন্দরবনের মাটির নিচে থাকা গ্যাস থেকে কখনও কখনও অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। বনের মধ্যে পচাপাতা থেকে তৈরি হওয়া মিথেন গ্যাসের স্তর জমে বনজীবীদের ফেলা বিড়ি-সিগারেট থেকেও আগুনের সূত্রপাত হয়। মৌয়ালরা মধু আহরণ করতে বনে আসেন। চাক ভাঙার সময় তারা আগুন ব্যবহার করেন। সেখান থেকেও বনে আগুন ছড়িয়ে থাকতে পারে।
তবে বন কর্মকর্তারা বলছেন, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ থেকেই অধিকাংশ সময় সুন্দরবনে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। কেননা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা এ বনের ওপর নির্ভরশীল। তারা বনের ভেতর প্রবেশ করলে অনেকেই শুকনো ডালপালা কিংবা গোলপাতার উপর বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ ফেলেন।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় নানা কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে রোববারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে বিড়ি অথবা সিগারেটের জ্বলন্ত অংশকেই দায়ী করা হচ্ছে।
তিনি জানান, সুন্দরবনের যে অংশে সেদিন (রোববার) আগুন লেগেছে তা লোকালয়ের পাশে। অনেকে গরু-ছাগল বনের ভেতর ছেড়ে দেন। যা খুঁজতে বনে প্রবেশ করার সময় অনেকে বিড়ি-সিগারেট নিয়ে ঢোকেন। এ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি আরও জানান, অনেক ঘটনা মৌয়ালী-বাওয়ালীর মাধ্যমে ঘটে থাকলেও সেদিনের ঘটনা তাদের মাধ্যমে ঘটেনি। কেননা ওখানে মধু নেই।
সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বনদস্যু ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য সুন্দরবনে বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো বনফায়ার সুন্দরবনে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা এখানের আবহাওয়া আর্দ্র।
যে কারণেই সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটুক না কেন তার সুষ্ঠু তদন্ত, অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমবে বলে মনে করেন তিনি।