হজের ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ!

Slider ফুলজান বিবির বাংলা রাজনীতি সারাদেশ সারাবিশ্ব

কনকন

 

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাব নেতাদের বিরুদ্ধে হজের ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। এ অর্থের হিসাব-সংক্রান্ত নথিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল জলিল তাঁর দপ্তরের পিএস আবদুল খালেক, পিও ইমামুল হক ও আরেক কর্মকর্তা আবসারকে শোকজ করেন। সচিবের মৌখিক নির্দেশে সেই নথি কোথায় আছে, তার তথ্য দিতে না পারায় ওই তিনজনকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে শোকজের জবাব দিতে বলা হয়। সাত দিন পার হওয়ার আগেই গত বুধবার শোকজের জবাব দেন তিন কর্মকর্তা।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুরোধে সৌদি সরকার গত বছর যে পাঁচ হাজার অতিরিক্ত হজযাত্রী পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছিল, তা নিয়েই ঘটে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা। এর মধ্যে ১৭ কোটি টাকা সরকারের, বাকি ২৮ কোটি টাকা হজযাত্রীদের। টাকা আত্মসাতের পর চক্রটি ওই পাঁচ হাজার হজযাত্রীর সংশ্লিষ্ট নথি গায়েব করে দিয়েছে, যাতে ঘটনা প্রমাণ করা না যায়।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নিয়মানুযায়ী অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে মোয়াল্লেম ফি ও বাড়িভাড়ার টাকা জমা দিয়েও সৌদি সরকারের কোটার কারণে যেতে পারছিলেন না ৩০ হাজার হজযাত্রী। তখন আন্দোলনে নামেন তাঁরা। পরে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সৌদি সরকার শেষ মুহূর্তে বাড়তি পাঁচ হাজার হজযাত্রীকে হজ করার অনুমতি দেয়। সৌদি আরবের সম্মতি ছিল সরকারি হজযাত্রী যাওয়ার ব্যাপারে। সে জন্য সরকারের কাছ থেকে ৩৩ কোটি টাকা ধার নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করেও যেতে না পারা হজযাত্রীদের না পাঠিয়ে অর্থ আত্মসাতের জন্য অন্যদের পাঠায় এ-সংক্রান্ত কমিটি। আর এ কাজে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোকে সরকারের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ঋণ দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। এসব ঘটনায় জড়িতদের কাছ থেকে এখন সরকারের অর্থ, হজযাত্রীদের দেওয়া অর্থ—কোনোটিই ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এ-সংক্রান্ত নথিও গায়েব।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল জলিল কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছর হজের শেষ দিকে পাঁচ হাজার হজযাত্রী পাঠানোর জন্য ৩৩ কোটি টাকা দেয় সরকার। ওই টাকা এজেন্সিগুলো সাময়িক ঋণ হিসেবে নিলেও এখনো টাকা ফেরত দেয়নি তারা। কোন এজেন্সির কাছে কত টাকা পাওনা, তা জানার জন্য সংশ্লিষ্ট ফাইলটি খোঁজা হয়। কিন্তু সেই ফাইল আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ফাইলটি স্থানান্তর বা সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িতদের এরই মধ্যে শোকজ করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তিন কর্মকর্তা শোকজের জবাবে জানিয়েছেন, সর্বশেষ সাবেক সচিব চৌধুরী বাবুল হাসানের দপ্তরে ছিল ফাইলটি। সচিব আগে থেকেই বিভিন্ন সময় ফাইলের গুরুত্ব অনুসারে তাঁর ড্রয়ারে তালাবন্দি করে রাখতেন। সচিবের দপ্তরে সাবেক উপসচিব (হজ) নাসির উদ্দিনের অবাধ যাতায়াত ছিল। তাই নাসির উদ্দিন এই ফাইল সম্পর্কে জানতে পারেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত বছর হজের সময় ধর্মসচিব হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী বাবুল হাসান। ধর্ম মন্ত্রণালয়ে তাঁর শেষ কর্মদিবস ছিল গত ৩১ জানুয়ারি। এরপর তিনি যোগ দেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। ওই সময় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব নেন মো. আবদুল জলিল। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটি তলব করেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। তখনই এটি খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।

জানা যায়, অতিরিক্ত পাঁচ হাজার হজযাত্রী পাঠাতে ধর্মমন্ত্রীর নেতৃত্বে বেসরকারি হজ এজেন্সির মালিকদের নিয়ে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্য থেকে হজযাত্রী না পাঠিয়ে যাদের অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করা ছিল না, তাদের পাঠায়। ওই কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, পাঁচ হাজারের কোটায় হজে যেতে ইচ্ছুকরা যেন হাবের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আড়াই লাখ টাকা করে জমা করেন। এখানেও অনিয়ম করা হয়। কারণ তখনো সরকারি সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল দুই লাখ ৬৯ হাজার টাকা। যেখানে সরকার নির্ধারিত হজ প্যাকেজের কমে কোনো এজেন্সির হজযাত্রী পাঠানোর আইনি সুযোগ নেই, সেখানে কমিটি কী করে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও কম খরচে পাঠানোর নির্দেশনা দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, ধর্ম মন্ত্রণালয় এজেন্সিগুলোর কাছে টাকা ফেরত চেয়ে দুই দফা পত্র দিলেও হাব দুই কিস্তিতে মাত্র ১৬ কোটি টাকা ফেরত দেয়। বাকি ১৪ কোটি টাকার কোনো খোঁজ নেই। ওই ১৪ কোটি টাকা ফেরত না দিয়ে এজেন্সিগুলোর মোয়াল্লেম ফির জন্য সরকারি ফান্ডের যে অ্যাকাউন্টে টাকা রাখা আছে, সেখান থেকে সমন্বয় করার কথা বলে হাব। তবে এতে সাড়া না দিয়ে মন্ত্রণালয় টাকা আদায়ের পদক্ষেপ নিলে তখনই জড়িতরা ফাইলটি গায়েব করে ফেলে।

হাবের সাবেক সভাপতি মো. জামালউদ্দিন সম্প্রতি মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে জানিয়েছেন, ওই পাঁচ হাজার হজযাত্রীর কাছ থেকে হাব আড়াই লাখ করে টাকা নিলেও খরচ হয়েছে জনপ্রতি এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে হাবের কাছে এখনো ওই ক্ষতিগ্রস্ত হাজিদের আরো প্রায় ২৮ লাখ টাকা জমা আছে। হাব সেই টাকাও দিচ্ছে না।

শোকজের জবাবে ভারপ্রাপ্ত সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) আবদুল খালেক লিখেছেন, হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিটি সচিবের দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবছার হোসেন গত ১৯ জানুয়ারি অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) দপ্তরের গতিবিধি রেজিস্ট্রারে স্বাক্ষরান্তে গ্রহণ করেন। একই তারিখে নথিটি সচিবের (চৌধুরী বাবুল হাসান) অনুমোদনের জন্য তাঁর একান্ত সচিবের টেবিলে দেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও সচিব নথিটিতে স্বাক্ষর করেননি। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন ধর্মসচিব তাঁর শেষ কর্মদিবসে চলমান প্রায় ৯০টি নথিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু হজ শাখার ২০১৫ সালের হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিটিতে স্বাক্ষর করেননি। আবদুল খালেক আরো বলেছেন, অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি সচিব তাঁর ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে রাখতেন। সচিব শেষ কর্মদিবসে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে যাওয়ার সময়ও হজ ব্যবস্থাপনার নথিটি তাঁর (আবদুল খালেক) বা তাঁদের কারো কাছে দিয়ে যাননি।

আবদুল খালেক আরো বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে সাবেক ধর্মসচিব চৌধুরী বাবুল হাসান ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিবের কক্ষে ঢোকেন। এ সময় ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিব সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ছিলেন। সাবেক সচিব কক্ষে ঢুকে তাঁর কাছে থাকা চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারসংক্ষেপের কভারে পেঁচানো এক বা একাধিক নথি বের করে নিজ হাতে নিয়ে গেছেন। তখন আবদুল খালেকসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও কেউ ভয়ে সাবেক সচিবকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। সচিবও বলেননি তিনি কী নিয়ে যাচ্ছেন।

শোকজ নোটিশ পাওয়া অন্য দুই কর্মকর্তাও প্রায় একই রকম জবাব দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও সহকারী প্রোগ্রামার ইমামুল হক এক জায়গায় লিখেছেন, সাবেক সচিব যখন ভারপ্রাপ্ত সচিবের অনুপস্থিতিতে ড্রয়ার খুলে নথি নিয়ে যান, তখন তাঁদের মনে হয়েছিল, অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি না হলে তিনি (সাবেক সচিব) নিজে এসে নথি নিতেন না।

এ বিষয়ে সাবেক ধর্মসচিব চৌধুরী বাবুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *