গাদ্দাফির সোনার পিস্তলের খোঁজে

Slider সারাবিশ্ব

 

2016_02_03_14_42_19_Fzsxy9SsWNuFpnsIcAn57BYAyNvMUy_original

 

 

 

 

২০১১ সালের ২০ অক্টোবর বিদ্রোহী জনতার হাতে নিহত হন লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তাকে হত্যার পর তার সোনার বন্দুক হাতে নিয়ে উচ্ছাসে ফেটে পড়েছিল বিদ্রোহীরা। তখন তাদের ছবি তুলেছিলেন বিবিসি প্রতিনিধি গাব্রিয়েল গেটহাউস। ‘জনতার বিজয়ের’ সাক্ষী হয়ে থাকা ছবিটি নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তুলেছিলেনি গাব্রিয়েল। গাদ্দাফির সেই সোনার পিস্তলটি এখন কোথায় আছে?  ছবির সেই হাস্যোজ্জ্বল মানুষগুলোই বা এখন কেমন আছে? সেই বিপ্লব  কি দিয়েছে লিবিয়ার জনগণকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই  সম্প্রতি  লিবিয়া গিয়েছিলেন গাব্রিয়েল। তার সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়েই বিবিসি’র প্রতিবেদন ‘My search for Gaddafi’s golden gun’।

লিবিয়ার বিদ্রোহীরা যখন স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করছিল তখন তাদের হাতে শোভা পাচ্ছিল সেই বিখ্যাত সোনালি পিস্তলটি। কিছুক্ষণ আগেই হত্যা করা হয়েছে লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফিকে। তখন তাদের হাতে চকচক করতে থাকা গাদ্দাফির ওই অস্ত্রটিই যেন বিজয় স্মারকে পরিণত হয়েছিল। একজনের হাত থেকে অন্যজনের হাতে ঘুরছিল সোনা নির্মিত অস্ত্রটি। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর হত্যা করা হয়েছিল গাদ্দাফিকে। তারপর কেটে গেছে আরো চার বছর। সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে বিবিসি প্রতিনিধির তোলা ওপরের ছবিটি। ছবিতে দেখা যায়, নীল শর্ট আর টুপি পরা এক যুবককে বিদ্রোহীরা কাধে তুলে নিয়েছে। হাস্যজ্জ্বল ওই যুবকের হাতেই শোভা পাচ্ছিল সোনালি বন্দুকটি। ওইসব বিদ্রোহীরা ছিল লিবিয়ার মিসরাতা এলাকার বাসিন্দা।

সে মুহূর্তে গাদ্দাফির ওই পিস্তলটি যেন বিদ্রোহীদের বিজয় প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। নতুন লিবিয়ায় জনগনের সরকার নির্বাচিত হওয়ার প্রতীক ছিল সেটি।

মাত্র চার বছরের ব্যবধানেই সব শেষ হয়ে গেছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এখন ক্ষমতা লড়াইয়ে লিপ্ত। সবাই চায় লিবিয়ার শাসক হতে। এ নিয়েই তাদের দ্বন্ধ। ক্ষমতার শূণ্যতার সুযোগে গাদ্দফির জন্মভূমি সিরতে শহরটি দখলে নিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। লিবিয়ায় আনোয়ার সুয়ামের সঙ্গে বিবিসি প্রতিনিধি গাব্রিয়েল

লিবিয়ার মিসরাতা শহরের অবস্থান রাজধানী ত্রিপলি থেকে দুই শ কিলোমিটার পূর্বে। এটি এখন আধা স্বাধীন শহর। এই শহরের বিদ্রোহীরাই চার বছর আগে গাদ্দাফিকে বন্দি ও হত্যা করেছিল। এখানকার বাসিন্দা আনোয়ার সুয়াম গাদ্দাফি বিরোধী বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী প্রথম সারির একজন। তিনিই তো গাদ্দাফির মৃতদেহটি দর্শকদের জন্য মাংসের বাজারের একটি রেফ্রিজারটরে রেখে দিয়েছিলেন। যাতে লোকজন তার লাশ দেখতে পারে। কিন্তু এখন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বেশ হতাশ। রাতে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর ভূমধ্যসাগরের তীরে সুস্বাদু চায়ে চুমুক দিতে দিতে  তিনি বলেন,‘এখানকার পরিস্থিতি ভালো নয়। আমরা একটা সাপের (গাদ্দাফি) মাথা কেটেছি। এখন শত শত সাপ তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। আমরা এখনো একই জিনিস নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে লিবিয়ার জন্য একজন প্রকৃত শাসক খুঁজে বের করা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সবাই শাসন করতে চায়। তাই চারপাশে কেবল বন্দুক আর বন্দুক। কি অবস্থা!’

সেদিন গাদ্দাফির পিস্তলটি ছিল ওমরান শাবান নামের এক বিদ্রোহীর হাতে। ওই যুবক নাকি উন্মাদ জনতার হাত থেকে গাদ্দাফিকে রক্ষা করারও চেষ্টা করেছিলেন। তখন গাদ্দাফির হত্যার দৃশ্যটি ধারণ করেছিলেন আনোয়ার। তার তোলা ছবিতে রক্তাক্ত গাদ্দাফিকে স্পষ্ট বোঝা যায়। তবে আনোয়ার মনে করেন গাদ্দাফির এটি পাওয়া ছিল। তিনি বলেন,‘ইসলাম আমাদের বন্দিদের সঙ্গে ভলো ব্যবহার করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু আমরা গাদ্দাফিকে বাঁচাতে পারিনি। জনতা তাকে পদদলিত করে হত্যা করেছে। আমরা তাদের ঠেকাতে পারিনি।’

গাদ্দাফির সোনার পিস্তল হাতে নিয়ে নায়ক বনে গেছেন ওমর শাবান। তিনি তখন ভেবেছিলেন কয়েক মাসের মধ্যে লিবিয়ার মানুষ তাদের ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারবে।  কিন্তু তার ধারণা সত্যি হয়নি। দেশটিতে লড়াই এখনো চলছে। ২০১২ সালে বনি ওয়ালিদ শহরে গাদ্দাফিপন্থিদের হাতে বন্দি হন শাবান। তারা তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিল। মিসনাতানের বাসিন্দারা তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আটককারীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফ্রান্সের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শাবান।

আনোয়ার সুয়ামের ধারণা, শাবান যখন গাদ্দাফির সমর্থকদের হাতে ধরা পড়েন তখন তার সঙ্গে সেই বিখ্যাত পিস্তলটি ছিল। সম্ভবত এটি এখন গাদ্দাফির ভক্তদের কাছে ফিরে গেছে। তবে শহরের অন্য একজন বিবিসি প্রতিনিধি গাব্রিয়েলকে জানিয়েছেন,অস্ত্রটি এখনো এ শহরেই আছে। তবে এটি কার জিম্মায় আছে, তা তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।

ছবিতে আর এক বিদ্রোহী ছিলেন। আনোয়ার জানান, তার নাম মোহাম্মদ ইলবিবি। কিন্তু তার অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানেন না আনোয়ার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গাব্রিয়েল তার ঠিকানা সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। তিনি তার বাড়িতে যান। বিবিসি প্রতিনিধির তোলা চার বছর আগের সেই সোনার পিস্তল সমেত ছবিটি দেখে হাসেন মোহাম্মদ ইলবিবি। বলেন,‘খুব মনে আছে। আমার বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর।’

ইলবিবি মনে করেন, গাদ্দাফিকে বাঁচানোর কোনো উপায় ছিল না। গাদ্দাফিকে যেখান থেকে ধরে আনা হয়েছিল সেখানেই মাটিতে পড়েছিল পিস্তলটি। ইলবিবি তা তুলে নেন। তার হাতে সেই অস্ত্রটি দেখেই অন্য বিদ্রোহীরা ধরে নেন, গাদ্দাফিকে তিনিই খুন করেছেন। এভাবেই দুর্ঘটনাবশত ‘হিরো’ হয়ে যান মোহাম্মদ। গাদ্দাফির সোনার পিস্তলটি এখনো তার কাছেই আছে। তিনি তা বের করে আনেন এবং গাব্রিয়েলকে দেখান। ৯ মিলিমিটারের এই পিস্তলটির নির্মাতা হচ্ছে মার্কিন অস্ত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ব্রাউনিং। সম্পূর্ন সোনা দিয়ে তৈরি এম-১৯১১এ১ পিস্তলটির গায়ে ফুলেল নকশা কাটা। অবশেষে গাদ্দাফির সেই পিস্তলের খোঁজ মিলল

মোহাম্মদ ইলবিবির ধারণা এটি গাদ্দাফির কোনো ছেলে তাকে উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিল। বিপ্লবের ৩২তম দিবসে নিজের পিতাকে উপহার দিয়েছিল তার ছেলে। সেও তো দশ বছর আগের কথা। দশ বছর পর পিস্তলটি এখন গাদ্দাফি যুগের পতনের স্মারক চিহ্ণ হয়ে আছে।

কিন্তু এই জিনিস আর কতদিন নিজের কাছে রাখতে পারবেন তা নিয়ে আতঙ্কে আছেন মোহাম্মদ। কারণ গাদ্দাফিপন্থিরা এখনো এ দেশে সক্রিয় আছে। ইতিমধ্যে তারা বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছে। তিনি বিবিসি প্রতিনিধিকে বলেন, ‘প্লিজ, আপনি সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে দিন, আমি গাদ্দাফিকে হত্যা করিনি।’

আগামী পাঁচ বছর পর লিবিয়ায় কি হবে তা নিয়েও তিনি কিছু ভাবতে পারেন না। তিনি এখন পুরোপুরি হতাশ। তিনি বলেন,‘পাঁচ বছর পর কি হবে আমি জানিনা। তবে আমি সত্যিই হতাশ। নিজেদের মধ্যে এই হানাহানি খুব খারাপ। এখন তো সবাই গাদ্দাফি হতে চান।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *