সরকারি লোকসানি কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিন

অর্থ ও বাণিজ্য

untitled-20_182585

 

 

 

 

 

শিল্প ও বিনিয়োগের স্বার্থে লোকসানে থাকা সরকারি শিল্পকারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, সরকারি অনেক কারখানা বছরের পর বছর লোকসান গুনছে। আবার বেসরকারি খাত নতুন বিনিয়োগের জন্য জমি এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এ বাস্তবতায় সরকারি লোকসানি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে লাভজনক করা সম্ভব। এ ছাড়া বন্ধ ও রুগ্ণ সরকারি কারখানার অব্যবহৃত জমি বেসরকারি খাতে বরাদ্দ দিলে জমি সংকট কিছুটা কাটবে। গতকাল রোববার রাজধানীর মতিঝিলে এমসিসিআই মিলনায়তনে খসড়া শিল্পনীতির ওপর ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি) আয়োজিত এক সংলাপে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নতুন শিল্পনীতিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।

 

সংলাপে ব্যবসায়ীরা শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা, অন্যান্য অবকাঠামো নিশ্চিত করা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণ বিষয়ে সুস্পষ্ট সময়সীমাসহ সরকারের কাছে বেশ কিছু দাবি জানান। এ ছাড়া বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়ানস্টপ সার্ভিসকে ‘অকার্যকর’ উল্লেখ করে বিনিয়োগের স্বার্থে প্রকৃত অর্থে এ ধরনের সেবা নিশ্চিতের অনুরোধ করেছেন তারা।

সংলাপের প্রধান অতিথি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, সরকারি কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান বিক্রি বা লিজ না দেওয়ার নীতি নিয়েছে সরকার। তবে কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা চাইলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) হতে পারে। বেসরকারি খাতের কেউ প্রস্তাব দিলে তা সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করবে। পাকশী এবং খুলনা কাগজকল নিয়ে এ ধরনের আলোচনা চলছে। আমির হোসেন আমু বলেন, বিনিয়োগের জন্য গ্যাসের সংকট সবার জানা। তবে বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ।

শিল্পমন্ত্রী আরও বলেন, শিল্পনীতি চূড়ান্ত করার আগে উদ্যোক্তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হবে। কোনো কিছু নীতিমালা অনুযায়ী হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাল-বিল ভরাট করে বাড়ি উঠছে। আবাসিক এলাকায় শিল্প হচ্ছে। ধীরে ধীরে পরিকল্পনার মাধ্যমে সবকিছু শিল্পনীতির মধ্যে আনা হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তেজগাঁও এলাকা থেকে শিল্প উঠে যাবে। সেখানে আবাসন গড়ে উঠবে। শিল্প সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া শিল্পনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি জানান, শিল্প সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে শিল্পনীতি করা হচ্ছে। এটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আগামী সপ্তাহে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর গেজেট আকার প্রকাশ করা হবে।

আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার মালিকানাধীন কারখানায় বিনিয়োগযোগ্য অনেক জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। এসব জমি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে ব্যবহারের জন্য বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত। শিল্পনীতিতে সেই সুযোগ রাখার প্রস্তাব করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জমির সংকটে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সরকার পরিবর্তনে নীতির পরিবর্তন, সেবা পেতে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান না হলে আগামীতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখা কঠিন হবে।

এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, বিদেশি উৎস থেকে উদ্যোক্তারা চার থেকে পাঁচ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে থাকেন। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার মজুদ এখন ২৭ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। এ মজুদ থেকে অন্তত চার বিলিয়ন ডলার উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া হলে সুদের ব্যয় হিসেবে ডলার দেশের বাইরে যাবে না। বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজেড নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। অথচ কবে এসবের কাজ শেষ করা হবে সে বিষয়ে কোনো সময়সীমা নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত বন্ধ কলকারখানা চালুর দাবি জানিয়ে এ. কে. আজাদ বলেন, এসব কারখানায় শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঈশ্বরদীর পাকশী কাগজ কলে ৪০০ বিঘা জমি পড়ে আছে। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বেসরকারি খাতে দিলে এ কারখানা লাভজনক করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘সরকার বলছে কারখানা চালাবে। আমি কাউকে ছোট করার জন্য বলছি না, মূল্যায়ন করার জন্য বলছি, ছয় মাস বা এক বছর পর আবার এই বিষয়ে আলোচনায় বসেন। মূল্যায়ন করেন সরকার তার কারখানায় কী করতে পেরেছে, আর বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা কী করতে পেরেছে।’

এফবিসিসিআইর অন্য সাবেক সভাপতি মীর নাছির হোসেন বলেন, সরকারি বন্ধ এবং লোকসানি শিল্পকারখানার কারণে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। খসড়া শিল্পনীতিতে এ বিষয়ে কোনো কিছু না থাকার সমালোচনা করেন তিনি। শিল্পকারখানায় পরিবেশ মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করছে জানিয়ে তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় থাকা প্রয়োজন বলে মত দেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিল্পবিষয়ক বিশেষ সহকারী মাহাবুব জামিল বলেন, বিনিয়োগের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কোম্পানি গঠন করতে জয়েন্ট স্টক থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। এ প্রতিষ্ঠানের জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। এর সমাধান হওয়া উচিত। ওয়ানস্টপ সার্ভিসকে অকার্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের সুপারিশ আমলে নেয় না কোনো মন্ত্রণালয় বা সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ সেবাকে আইনি ভিত্তি দিয়ে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তিনি।

সংলাপে নোয়াব সভাপতি এবং দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, শিল্পে অগ্রগতির জন্য উন্মুক্ত, বাধাহীন পরিবেশ দরকার। প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেসরকারি বিজ্ঞাপন দিতে সরকারি পর্যায় থেকে বাধা দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রীর সহযোগিতা চান তিনি। তিনি বলেন, এ রকম ৩৩ প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপন দিতে বাধা দিচ্ছে সরকার। জবাবে শিল্পমন্ত্রী ইতিবাচক লেখনীর মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রথম আলো সম্পাদকের প্রতি আহ্বান জানান।

ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম বলেন, বিনিয়োগে শিল্পের শ্রেণীকরণ নিয়ে এক ধরনের জটিলতা আছে। শিল্পের আকার ভেদে সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা না থাকায় ঋণ পেতে জটিলতা হচ্ছে। পরিবেশ সহায়ক সবুজ শিল্প এবং পোশাক খাতে চলমান সংস্কার কাজে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।

অ্যামচেমের সাবেক সভাপতি আফতাব-উল-ইসলাম বলেন, বর্তমান শিল্পনীতি অবহেলিত। মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত নীতিপত্র ছাড়া এর কোনো কার্যকারিতা নেই। কাফকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তৌফিক আলী বলেন, বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পনীতি কার্যকর করতে শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে মনিটরিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর রুমী আলী বলেন, আমানতের সুদের হার কমেছে। বিনিয়োগ সহায়তা হিসেবে ঋণেও সুদের হার কমে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা উচিত। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, অভিজ্ঞতা বলছে, শিল্পনীতি বাস্তবায়নের সামর্থ্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের নেই। দক্ষ লোকবল বাড়িয়ে মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *