কথিত পীর ও বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী কয়েকজনকে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনার মধ্যে এ ধরনের হত্যার ‘পরিকল্পনাকারী’ নতুন এক জঙ্গি সংগঠনের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
জেএমবির আদলে গঠিত ‘মুজাহিদ অফ বাংলাদেশ’ নামে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ‘মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে’ এক ‘হুজুরকে’ হত্যার পরিকল্পনা করছিল বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম, নতুন সংগঠনটির সদস্যরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার ‘মতাদর্শে’ বিশ্বাসী।
“তারা আল কায়দাকে অনুসরণ করে, তবে আল কায়দার সঙ্গে তাদের কোনো নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি। তারা সেলফ মোটিভেটেড।”
রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকায় সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে বুধবার সন্ধ্যার পর ‘মুজাহিদ অফ বাংলাদেশ’ সংগঠনের ছয় সদস্যকে আটক করে বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের সামনে আনে পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবি কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটকরা পুলিশকে জানিয়েছে, তাদের সংগঠনে এখন পর্যন্ত ২৫ থেকে ৩০ জন সদস্য রয়েছে।
“এরা সবাই গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক সংলগ্ন এলাকায় এবং চট্টগ্রামের বনাঞ্চলসহ কয়েকটি স্থানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তারা ঢাকায় এক হুজুরকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল।”
তবে কোন ‘হুজুর’কে হত্যার পরিকল্পনা তারা করছিল, তা সাংবাদিকদের জানাননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মনিরুল বলেন, “আটকরা বিচিত্র সব নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশে তাদের সংগঠন ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।”
আটক ছয়জন হলেন- জহিরুল ইসলাম ওরফে ‘আনসার’ ওরফে ‘চূড়ান্ত লড়াই’ ওরফে জহির; খন্দকার রাজেশ সুবহান ওরফে ‘রাজু’ ওরফে ‘কাঁচা মরিচ’ ওরফে ‘আদার ব্যাপারী’; আবু বকর সিদ্দিক ওরফে ‘আবির’ ওরফে ‘মৌমাছি’ ওরফে ‘নিয়মের অনিয়ম’ ওরফে ‘একটুকরা মেঘ’ ওরফে ‘সাদা পাতা’; আব্রাহাম আহমেদ আল তারেক; মোরশেদুল ইসলাম ওরফে ‘কিং মোর খান’; কাজি বাপ্পি আহমেদ ওরফে ‘সাজ্জাদ’ ওরফে ‘তারেক বিন জিয়া মোল্লা আকতার মোহাম্মদ মনসুর’।
বিচিত্র এই নামের বিষয়ে মনিরুল বলেন, “এগুলো তাদের ফেইসবুক আইডির নাম। গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে তারা এসব নাম ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে।
“প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এরা জানিয়েছে, ফেইসবুকের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তারা যোগাযোগ রক্ষা, সদস্য ও অর্থ সংগ্রহ করে থাকে।”
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইসলামী ফ্রন্টের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীসহ কথিত পীর ও বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী কয়েকজনকে হত্যার ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে গত ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় নিজের বাড়িতে গলা কেটে হত্যা করা হয় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে। খিজির খানের বাড়িতে একটি খানকা শরীফ ছিল এবং অনেকে তাকে পীর মানতেন।
এর আগে ২০১৪ সালের ২৭ অগাস্ট ঢাকার রাজাবাজারের বাসায় একইভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয় ইসলামী ফ্রন্টের নেতা ফারুকীকে।
রাজধানীর গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ ছয়জনকে গলাকেটে হত্যা করা হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে।
গত কয়েক বছরে এক প্রকাশকসহ কয়েকজন ব্লগার ও লেখকও বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
খিজির খান ও গোপীবাগ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার জেএমবি সদস্য তরিকুল ইসলাম মিঠু আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
‘পীর’ খিজির খানের মতাদর্শকে ‘ধর্মীয় বিচ্যুতি’ ধরে নিয়ে জেএমবি সদস্যরা ‘ঈমানি দায়িত্ব’ মনে করে তাকে হত্যা করেছে বলে মিঠু পুলিশকে জানিয়েছিলেন।
নতুন জঙ্গি সংগঠনটির আটক ছয় সদস্যকে বরাত দিয়ে ডিবির যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল বলেন, তারা ছোরা চালানো ও বর্শা নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
“তাদের ধারণা বর্শা চালানোতে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে অস্ত্র চালানোতেও দক্ষ হয়ে উঠবে। এতে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর দরকার হলে তাদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।”
এই ছয়জনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছয় দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ।
বিকালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে তাদের হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করেন গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা আবুল বাশার।
তিনি ১০ দিনের হেফাজত চাইলেও হাকিম রাশেদ তালুকদার শুনানি নিয়ে ৬ দিনের হেফাজতের আদেশ দেন।
হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে আরও তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছে পুলিশ।