বাংলাদেশে মৃত্যু ও ধবংসের চক্র

Slider ফুলজান বিবির বাংলা রাজনীতি

103245_Untitled-1

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৩ সালের ১৭ই জুলাই ফজলুল কাদের চৌধুরী যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের ধারণা ছিল তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, যিনি লন্ডনের যোগ্যতাস¤পন্ন একজন ব্যারিস্টার ছিলেন, তিনি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শেখ মুজিবুর রহমানের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। সেদিন তাজউদ্দীন আহমেদকে সতর্ক করে দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের বলেছিলেন, ‘আপনার সময়ও আসবে। ওই কারাগারের কক্ষগুলোতে ফার্নিচার, আসবাবপত্র ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র লাগিয়ে আসলেই ভালো হবে।’
সালাউদ্দিন চৌধুরী নিজেও হয়তো জানতেন না, তার সেদিনকার কথাগুলো কতটা নির্দয় ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ ছিল। মাত্র দুই বছর পর শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য তার ধানমন্ডির বাসায় নির্দয়ভাবে খুন হন। তাজউদ্দীন আহমেদ ও অন্য মন্ত্রীদের টেনেহিঁচড়ে ঢাকার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। শেখ মুজিবের হত্যাকারী অথবা তাদের কট্টর সমর্থকরা কারাগারে ঢুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তাদের।
জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ স¤পাদক আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও এখন ফাঁসি দেয়া হলো। ২০১০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা ওয়াজেদের প্রতিষ্ঠিত দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের অক্টোবরে ফাঁসির দ- দেয় সালাউদ্দিনকে। তার করা আপিল খারিজ করে দেয় বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট।
যথাযথ প্রক্রিয়াই এখানে অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু এ উপমহাদেশে, যেখানে সাক্ষী কেনাবেচা করা যায়, প্রমাণও যেখানে প্রায়ই কাগজে লেখার উপযুক্ত নয়, সেখানে এসবের মূল্যই বা কি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আর কতদিন বাংলাদেশ অতীতের কয়েদি হয়ে থাকবে, যে অতীত প্রতিশোধ ও ন্যায়বিচারের মধ্যকার পার্থক্য অস্পষ্ট করে দেয়? সত্যিকারের স্বাধীন হওয়ার জন্য কখন বাংলাদেশ পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস অর্জন করবে?
মৃত্যু ও ধ্বংসের চক্রে আরেকটি সংযোজন সালাউদ্দিনের মৃত্যু। সামাজিক স্থিতিশীলতা উপভোগ করার যে সুযোগটুকু বাংলাদেশের এখনও রয়েছে, এ চক্র তাও ধ্বংস করতে পারে।
সমান্তরাল আরেকটি বিষয় যেটি মাথায় আসে, তা হলো ভিয়েতনাম, যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ও তিক্ত একটি যুদ্ধ লড়েছিল। কিন্তু বহু বছর ধরে চলা সংঘাতের তিক্ততা ভিয়েতনামে যতটা স্মরণ করা হয়, তার চেয়ে বেশি করা হয় দেশটির বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতপার্থক্য মিটিয়ে ফেলাই হবে জাতীয় ভবিষ্যতের জন্য উত্তম, এ পরিপক্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছিল ঐক্যবদ্ধ ভিয়েতনামিজরা। এ কারণেই তারা অতীতের দাস নয়, বরং তারা অতীতকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। তারা ভারতীয়দের মতো নয়, যারা সড়কের নাম পরিবর্তন করে বা ব্যক্তি-ভাস্কর্য অপসারণ করে ইতিহাসকে মুছে ফেলার শিশুতোষ প্রচেষ্টা চালায়। ভিয়েতনাম গর্বের সঙ্গে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সব টানেল ও ধ্বংসাবশেষ অক্ষত রেখেছে।
অনুরূপ ঘটনা আরেকটি হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা, যে দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয়-বংশোদ্ভূত নাগরিকরা বহু দশক ধরে চলা নিষ্ঠুর নিপীড়নমূলক শাসনে সবচেয়ে কঠোর বর্ণবাদী বৈষম্যের ভুক্তভোগী ছিল। তারাও অতীতের শত্রুতা কাটিয়ে উঠে নিজেদের জন্য নতুন জীবন সৃষ্টির সাহসী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এটা সত্য, অনেক শ্বেতাঙ্গ বহুজাতিক সমাজে বসবাস না করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি এক শ্বেতাঙ্গ পরিবারকে চিনি। তারা পুরনো দক্ষিণ রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) থেকে জাতিবিদ্বেষ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে গিয়েছিল। কারণ, তারা বিশ্বাস করেছিল ওই দক্ষিণ আফ্রিকাই তাদের জন্য অনেক বেশি সাম্যের দেশ হবে। তারা কিন্তু হতাশ হয়নি। এটার অন্যতম কৃতিত্ব বিশপ ডেসমন্ড টুটুর। তার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সর্বজনীন দূরদর্শিতার ফলে গঠিত হয়েছিল কমিশন অব ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন। এ কারণেই তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করেন।
এ জিনিসটিই আহত ও ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের খুব বেশি দরকার। এ দেশটি এক রাষ্ট্রনায়কের নিরাময়ের ছোঁয়ার জন্য আর্তনাদ করছে। যে রাষ্ট্রনায়ক ইতিহাস বুঝবেন, ফলে নিজের ব্যক্তিগত শোকের অন্ধকার ছাড়িয়ে উজ্জ্বলতর দিগন্তে চোখ রাখতে সক্ষম হবেন। তা যতদূরেই হোক না কেন। শাসকের আকস্মিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা যে দেশগুলোর রয়েছে, সেখানে সমাপ্তি খুব সুখকর হয়নি।
এটা ভাবা মূর্খতা হবে যে, বৃটিশ শাসনের সময় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সকল জ্যেষ্ঠ ভারতীয় সদস্য তৎকালীন কংগ্রেস দল ও ‘স্বরাজ’-এর লক্ষ্য সমর্থন করেছিলেন। আবেগি জহরলাল নেহরু তাদেরকে বহিষ্কার করার জন্য উত্তেজিত হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু চির বাস্তববাদী বল্লবভাই প্যাটেল নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্য কিছু। তিনি অবশ্যই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, সরকারি ব্যক্তিদের তাদের ওই সময়ের প্রেক্ষাপটের বাইরে বিবেচনা করাটা অন্যায্য।
সালাউদ্দিনের পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির পঞ্চম স্পিকার। আইয়ুব খানের অধীনে কনভেনশন মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। তিনি কিছু সময়ের জন্য পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টও ছিলেন। রাঙ্গামাটির চাকমা প্রধান রাজা ত্রিদিব রায়ের মতো তিনিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, তার সে অধিকারও ছিল। কিন্তু তিনি কোন যুদ্ধাপরাধ করেছিলেন কিনা যার দরুন তাকে কারাদ- দেয়া হয়েছিল, সে ব্যাপারে আমার জানা নেই। আটক থাকা অবস্থায় তার আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও তাকে বিচারের মুখোমুখি করার প্রয়োজনীয়তা এড়াতে পেরেছিল কর্তৃপক্ষ।
সালাউদ্দিনও সম্ভবত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। তাকে আমি যখন জানতে পেরেছি, ততদিনে তিনি নতুন বাস্তবতা মেনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশেই তিনি রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গঠনের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন। নিজের এলাকা চট্টগ্রাম থেকে কমপক্ষে ছয় বার তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। প্রাথমিকভাবে তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে কাজ করেছেন। পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে হিন্দু গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগের হিন্দু ও মুসলিম কর্মীদের উদ্দেশ্যমূলক হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অনেক ভারতীয়র সন্দেহ, তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের সহায়তা ও সমরাস্ত্র সরবরাহ করে আসছিলেন। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। আর যুদ্ধের পর মাথার খুলির পাহাড়ের যে দৃশ্য সবাই দেখেছিল, তাতে করে এটা আশ্চর্য্যজনক নয় যে, ওই ক্ষত দীর্ঘদিন থেকে যাবে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এ ক্ষতকে জীবিত রাখে, রক্তপাত ঘটায়। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন ও বেছে বেছে ও বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের হত্যা বাংলাদেশী সমাজের মৌলিক একটি অস্থিতিশীলতার কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত, যখন একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছে ভেবে ভারতীয়রা উদ্যাপন করছিল, তখনই হয়তো পূর্ব বাংলার কিছু মুসলিম বেছে বেছে হত্যা করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন।
পাকিস্তান বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন তৎকালীন এমন এক বাঙালি কূটনীতিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কথা শোনার পর ঢাকায় ফেরার উদ্দেশে রওনা দেন। তিনি ও তার মালামাল তখন মাঝ সমুদ্রে। কি মনে করে তিনি এক পর্যায়ে জাহাজ থেকে নেমে যান কাছের এক বন্দরে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রগামী আরেকটি জাহাজে মালামালসমেত উঠে যান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রেই তিনি বাকি জীবন কাটিয়েছেন। তিনি আসলে বিজ্ঞ ছিলেন।

[সুনন্দা কে. দত্ত রায় ভারতের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক। উপরের লেখাটি ভারতের দ্য এশিয়ান এইজ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ট্রাবল্ড ঢাকা’ শীর্ষক তার নিবন্ধের অনুবাদ।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *