বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান!

বাধ ভাঙ্গা মত
untitled-34_174990
সেলিম রেজা নূর
অবশেষে সাকাচৌ আর মুজাহিদ কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে। তার আগে তারা মৃত্যুর প্রহর গুনেছে। ফাঁসির আদেশ শোনার জন্য প্রতীক্ষমাণ! এই প্রতীক্ষার প্রহর মৃত্যুযন্ত্রণা থেকেও ভয়াবহ! স্বদেশে অজস্র কুকীর্তি আর মনুষ্য-জাতির প্রতি চরম জিঘাংসামূলক পাপাচারের মূল্য এখন সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে এ দুই কুখ্যাত রাজাকার-হার্মাদ-দস্যুকে! স্বদেশে মুক্তি আর স্বাধীনতার আন্দোলনকালীন সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে বরাবর এসব অমানুষ দেশ ও জাতির বিপক্ষে অবস্থানই শুধু নেয়নি; বরং দেশ ও জাতির সঙ্গে বেইমানি করে আমাদের জানি দুশমন ‘ফাকিস্তান’-এর সঙ্গে মিতালির বন্ধনে আবদ্ধ থেকেছে বরাবর। অবশেষে ওদের পেয়ারা পাকিস্তান আর ‘ধর্ম’ রক্ষার নামে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে একাত্তরে এজিদ-সীমারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ৩০ লাখ আদম সন্তানের বুকের রক্তে হোলি উৎসব করেছিল! বরাবরের মতোই ওদের বিধি বাম! ‘৫২, ‘৬২, ‘৬৬, ‘৬৯, ‘৭০ আর ‘৭১-এ বারবারই দেশ ও জাতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পরাজিত হয়েছে। একাত্তরে চরম মূল্য দিয়েই বাঙালি জাতি তার স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল ঠিকই। ফলে এই হত্যাকারী, জল্লাদ বাহিনী সেদিন একাত্তরে আমাদের বিজয়লগ্নের সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকার বিবরে মুখ লুকিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল বেঁচে যাওয়ার! ছলে-বলে-কৌশলে ফিরেও এসেছিল আমাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ আর মীরজাফরদের চেষ্টায়, প্ররোচনায় পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে! রাজাকার-আলবদরশ্রেষ্ঠ সাকাচৌ আর মুজাহিদদের এতদিনকার হম্বিতম্বি দেখেশুনে মনে হয়েছিল, ওদের রাজনৈতিক জীবনে আর বুঝি কোনো সূর্যাস্ত নেই। স্বদেশে এদের রাজনৈতিক অবস্থান মধ্য-গগনের সূর্যের মতোই দেদীপ্যমান থাকবে চিরকাল!
না, জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। দেশ ও জাতিকে বুঝিয়ে দিলেন_ এত কিছু বিভ্রান্তি-নষ্টামি-ষড়যন্ত্রের মন্ত্রবলের পরও এ জাতির জীবনে তবুও সূর্য ওঠে, সূর্য উঠবে। উঠতেই হবে বিধির বিধানবলে; প্রকৃতির নিয়মবলে। কারণ ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করে যারা, তাদের পাপমূল্য ঘুচাতেই হবে। সেটাই বিধির বিধান! বহু দিন-মাস-বছর যন্ত্রণায় যন্ত্রণায় বক্ষ আমাদের বিদীর্ণ হয়েছে সাকাচৌ আর মুজাহিদদের আস্টম্ফালন আর আত্মম্ভরিতা দেখে দেখে! নিষ্পলক রাতে বোবাকান্নায় গুমরে গুমরে উঠেছি এই হতাশাবোধে আক্রান্ত হয়ে হয়ে_ আমার বাবা দৈনিক ইত্তেফাকের স্বনামধন্য বার্তা সম্পাদক ও পরবর্তীকালে কার্যনির্বাহী সম্পাদক শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি কি কোনোদিনও হবে না এই বাংলা নামের দেশে! আমার মা সেই বিচার আর শাস্তি দেখে যেতে পারেননি। আশঙ্কা হচ্ছিল_ আমরাও পারব না দেখে যেতে! না; সে আশঙ্কা অমূলক বলেই আজ প্রতীয়মান! এখন বিশ্বাস করতে পারি_ ‘বিধির বিধান’ খণ্ডাবে কে? এসব অমানুষ, হত্যাকারী, পাপিষ্ঠ কি আজ এই প্রতীক্ষিত মৃত্যুপ্রহরে অনুভব করতে পারে নিরপরাধ, নিরস্ত্র, নিষ্পাপ বাঙালিদের হত্যার সেসব মুহূর্ত আর ক্ষণকে? সেই যন্ত্রণাবোধকে? বাঁচার সেই আকুতিকে?
‘পাপ কখনও চাপা থাকে না’_ সেই আপ্তবাক্য আজ সত্যি হয়ে প্রকটভাবেই প্রকাশিত হয়ে পড়ল আমাদের এই জীবনে! প্রাচীন গ্রিক মহারথী নাট্যকার সফোক্লিস যেমন তার ইডিপাস রেক্স নাটকে মানবজীবনের এই ভঙ্গুরতাকেই তুলে ধরেছেন_ দোলনা থেকে কবরে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত একটিবারের জন্যও ভেবো না :তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ; তোমার সব চাওয়া-পাওয়া শেষ। ইডিপাসের মতোই বিধির বিধানে এক মুহূর্তেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে; হয়ে যায়! যেমন আমাদের কবি নজরুল গেয়ে উঠেছেন এই বলে :’চিরদিন কাহারো সমান না-হি যায়।/আজিকে যে রাজাধিরাজ কা’ল সে ভিক্ষা চায়।’ সাকাচৌ আর মুজাহিদ আজ যে বাঙালি আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল; সেই বাংলাদেশের বাঙালি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছে। বলিহারি, কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা! আশির দশকের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের ‘শেক্সপিয়র কোর্স’-এর কিং লিয়র নাটকটি পড়াতেন শিক্ষাগুরু প্রফেসর খান সারোয়ার মুর্শিদ! বহু দিন ধরেই স্যার নাটকটি পড়াচ্ছিলেন! মনে আছে, ৯-১০ মাস অতিক্রান্ত হলেও (তখন অবশ্য ঘন ঘন আমরা কুখ্যাত ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’-এ আক্রান্ত হতাম!) কিং লিয়র পাঠ আর শেষ হচ্ছিল না! বলতে দ্বিধা নেই, অধ্যাপক খান সারোয়ার মুর্শিদ স্যারের ইংরেজির ক্লাস; তারপরে আবার শেক্সপিয়রের পাঠ_ বোঝার মতো ছাত্র আমি সেদিনও ছিলাম না, এখনও নই। স্যার পড়িয়ে যেতেন, কিন্তু অর্ধেকের অর্ধেকও বুঝতাম না! তবে পড়ালেখা ব্যতিরেকে অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমি স্যারদের রুমে বেশ যাতায়াত করতাম। সে সুবাদে বেশ কয়েকবার মুর্শিদ স্যারের রুমে চলে গেছি, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপও করেছি; অত রাশভারি স্যার খুশি হতেন, সেটা বুঝতাম। একদিন কী মনে করে জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘স্যার, শেক্সপিয়রের শ্রেষ্ঠতম চারটি ট্র্যাজেডিতে এত রক্তারক্তি, এত মৃত্যু, স্টেজজুড়েই খালি মৃতদেহ, এমনকি ভালো চরিত্র সব মরে যাচ্ছে, কর্ডেলিয়ার মতো ফুলের মতো নিষ্পাপ নায়িকা বাঁচে না_ হ্যামলেট, সব জেনে-বুঝে জানতে পেরেও বাঁচে না। এর মধ্য দিয়ে কী জগৎ আমাদের দেখাতে চাইছেন গুরুর গুরু শেক্সপিয়র?’ স্যার একটু হাসলেন, কারণ ক্লাসে ইতিমধ্যেই তিনি এসব নিয়ে যে লেকচার ঝেড়েছেন তা যে আমার মাথার বহু ওপর দিয়ে চলে গেছে সে-ই ফাঁকিটা ধরতে পেরে! তারপরও ধৈর্য সহকারে বললেন, মূলত শেক্সপিয়র জীবনকেই চিত্রিত করেছেন নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই জগৎ-সংসারে প্রতিনিয়ত চলছে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব, ধর্ম-অধর্মের দ্বন্দ্ব, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব্ব! সেই দ্বন্দ্বে সর্বদাই ভালো-শুভ-ধর্ম-সত্যকে শুধু মূল্য নয়, চরম মূল্য দিয়েই সেগুলোকে রক্ষা করতে হয়। ক্ষণিকের জন্য পাগলা হাওয়ার মতো, ঝড়ো হাওয়ার মতো আমাদের জীবনে অশুভ-অধর্ম-মিথ্যা-মন্দ এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিতে চায়। সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে উদ্যত হয়। কিন্তু অনেক ক্ষয়ক্ষতির পরেও জয় হয় শুভ-কল্যাণ-ধর্মের। সত্যম-শিবম-সুন্দরম অধিষ্ঠান পায়, টিকে থাকে! হ্যাঁ হ্যামলেটরা মরে যায়, কর্ডেলিয়া, ডেসডিমোনারা চরম মূল্য দিয়ে চলে যায় সত্য; কিন্তু ইয়াগো-এডমান্ডদের শয়তানির রাজত্ব কিন্তু টিকতে পারে না, অবিনাশী হয় না, সত্যম-শিবম-সুন্দরমের চরম মূল্যদানের মধ্য দিয়েই ওই শয়তানদের পরাজয় ঘটে, মূলোৎপাটন হয়; তারপর? তবুও সূর্য ওঠে। তা-ই সত্যম-শিবম-সুন্দরমের প্রতীক গল্গস্টারের সুসন্তান এডগার জয়ী হয়ে তার বাবা গ্গ্নস্টারেরই কুসন্তান এডমন্ডের শয়তানির রাজত্ব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনকর্তা রাজা হয়ে বসেন; তেমনি রাজপুত্র ফর্টিনব্রাসের হাতে রাজপুত্র হ্যামলেটের রাজত্ব চলে যায় চাচা ক্লডিয়াসের শয়তানি-ষড়যন্ত্রের সব জালকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েই! এমনি করেই গুরুর গুরু শেক্সপিয়র বিধির বিধানের অধিষ্ঠান ঘোষণা করেন। কারণ সেটাই জীবন সত্য!
এত দিন পর মনে হয়, গুরু শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক জগৎ দিয়েই বুঝতে পারি_ এই নিত্য শুভ-অশুভের দ্বান্দ্বি্বক অবস্থানের কারণেই একাত্তরে এক দল শয়তানের আবির্ভাব হয়েছিল এই বাংলায়, যারা সব শুভ-কল্যাণ-মঙ্গলময়তাকে উপড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল। ক্ষণিকের জন্য এই সাকাচৌ-মুজাহিদরা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সারা দেশ-মাটি-মাকে! সেই অশুভের তাণ্ডব নাচনে আমার বাবা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো নিরস্ত্র-নিরীহ-নিষ্পাপ মানুষদের অকাতরে জীবন দিয়ে যেতে হয়েছিল! কিন্তু শয়তানের দল টিকে থাকতে পারেনি! আবার তারা এসেছিল পঁচাত্তরে। মনে হয়েছিল_ এবার মৌরসিপাট্টা নিয়েই বসে গেছে। কিন্তু না। প্রকৃতির নিয়মে, বিধির বিধানে শয়তান-অশুভ-অকল্যাণ-মিথ্যার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আর আজ বাংলাদেশে সেই জীবননাট্যেরই তো শেষ দৃশ্যের মঞ্চায়ন আমরা দেখছি! সাকাচৌ-মুজাহিদ-নিজামী বিধির বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ভেবেছিলে_ টিকে যাবে। না; সেটি হওয়ার নয়! পচা শামুকেও পা কাটে! যে নারীকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে আগস্ট ট্র্যাজেডি ঘটিয়ে; আল্লাহ্র কী অদ্ভুত লীলায় সে জন গেলেন বেঁচে, আর আজ তার হাতেই তোমাদের অপরাধের শাস্তি মিলল_ এই হলো বিধির বিধান!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *