ভালোবাসার অন্যপিঠে বিশ্বস্ত মৃত্যু

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

 

2015_11_17_18_24_57_jjurwOfsmCCKG0NoffVs5LIlpgMZUu_original

 

 

মৃত্যুর ছয়মাস এগারো দিন আগে মেয়েটির সন্ধান পায় সিনেটর ওনেসিমো সানচেয। রোজাল ডেল ভিয়েরিতে সাক্ষাৎ ঘটে মেয়েটির সঙ্গে। এক মায়াময় গ্রাম। রাতের কালোবাজারিতে জাহাজ ঘাটের রমরমা ব্যবসা। দিনের বেলা মরুভূমির মতো অপ্রয়োজনীয় এই জায়গাটা। সাগরের মুখোমুখি জায়গাটি দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিপাতহীন। সাগরটা যে কোন দিকে গেছে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এখানে বসবাস করলে মানুষ ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে এটাও হলফ করে বলা যাবে না। সকলে উক্ত স্থানটি নিয়ে ইয়ারকি মারে। একটি মাত্র গোলাপ কানে গুঁজে গ্রামটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সিনেটর ওনেসিমো সানচেয। লরা ফারিনার সঙ্গে যখন সিনেটরের দেখা হয় তখন ছিল বিকাল।
ভোটের কারণে প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর তাঁকে এখানে আসতে হয়। সকালে এসে পৌঁছেছে গাড়ির শোভাযাত্রা। ভোট সভার লোকসংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্যে ভাড়া করে আনা হয়েছে গাড়ি ভর্তি ইন্ডিয়ান লোকজন। এগারোটা বাজার খুব কাছাকাছি সময়ে গান বাজনা বাজিয়ে সিনেটর ওনেসিমো সানচেয সেখানে হাজির হয়েছেন তার দলের লোকজন সমেত। জিপ গাড়ির শোভাযাত্রা ও তার মন্ত্রিসভার গাড়ির সঙ্গে আনা হয়েছে জাম রঙের দামি সোডা গাড়ি। এ সবই তারই প্রচারের লক্ষ্যে। সিনেটরের গাড়িতে এয়ারকন্ডিশনড থাকায় বাইরের আবহাওয়া কিছুই ভেতরে ঢুকছে না। তিনি খুব ধীর ও সুস্থিরভাবে বসে আছেন ভেতরে। কিন্তু গাড়ির জানালা খুলতেই এক দমকা আগুনের তাপে তাঁর গা কেঁপে ওঠে। গায়ের সিল্কের শার্ট হালকা সুপে ভরে গেলো। তাকে তখন আরো বেশী বয়সী ও নিঃসঙ্গ লাগছিল। অথচ তার আসল বয়স মাত্র বিয়ালিশ। সে গটিনজেন ইউনিভার্সিটি থেকে মেটালার্জিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ অনার্স। পড়াশুনায় গভীর আগ্রহী। বই পড়েন মনোযোগি পাঠকের মতো। বাজে ল্যাটিন ক্লাসিক অনুবাদ পড়ে পড়ে তার মেজাজ বিগড়ে গেছে। এসব বই পড়ে তার বিরাট কিছু মনে হয়নি। এক প্রভাবশালী জার্মান মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি পাঁচ সন্তানের জনক। বাড়িতে তারা খুব সুখি ছিলেন। এবং তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি খুশি। কিন্তু এই ক্রিসমাস আসতে আসতে তিনি যে মারা যাবেন এ খবরে সবাই ব্যথিত। খবরটি তিনি পেয়েছিলেন তিনমাস আগে।

পাবলিক র‌্যালিতে যাবার আগে এক ঘণ্টার জন্য ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সিনেটর। কাজের ফাঁকেই এই এক ঘণ্টা তাঁর জন্য ম্যানেজ করা হয়েছে। এক গ্লাস পানি পান করলেন শোবার আগে। মরুভূমির ঝড়েও কানে গোঁজা গোলাপটি তখনো অক্ষত। এরপর সঙ্গে রাখা ডায়েটিং সিরইয়্যাল খাবার খেলেন। যার ফলে সকলের সঙ্গে ভাজা ছাগলের মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারলেন তিনি। খাবারের পর অনেকগুলো ব্যথানাশক বড়ি খেলেন। বড়িগুলো ব্যথা ওঠার আগেই ব্যথা উপশম করে ফেলে। নেটের ঝুলানো শয্যায় বসে ফ্যানের বাতাস খাচ্ছেন তিনি। শরীর টানটান করে গোলাপের ছায়ায় পনেরো মিনিট বিশ্রাম নিলেন একেবারে বস্ত্রহীন শরীরে। ঘুমানোর আগে যেন মৃত্যুর কথা মনে না পড়ে তাই এসব কৌশল অবলম্বন করেন মাননীয় সিনেটর। ডাক্তার ছাড়া তার এরূপ অবস্থার কথা কেউ জানতো না। মৃত্যুর কথা একা নিজেই সহ্য করতে চান তিনি। অসুখের কথা সবার সঙ্গে বলতে তার গর্ববোধ হয় না বরং খুব লজ্জা লাগে। তিনি বাইরে এমনভাবে চলাফেরা করেন যে কারও চোখে তার গোপন অসুখের কথা ধরা পড়ে না।

নিজেকে পুরোপুরি আয়ত্বে এনে দুপুর তিনটায় মিটিংয়ে যোগদান করলেন তিনি। বিশ্রাম শেষে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়েছেন। পরেছেন খসখসে লিনেনের ট্রাউজার ও সিল্কের শার্ট। আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন কয়েকটা ব্যথানাশক বড়ি খেয়ে। তাঁর ভাবনারও বাইরে গিয়ে সাংঘাতিকভাবে মৃত্যুর আলামত দেখা দিয়েছে। বক্তব্য দেবার বেদিতে যেতে তাঁর এখন রীতিমতন ঘৃণা ধরে গেছে। বিশেষ করে যারা তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্য মরিয়া হয়ে স্ট্রেজের দিকে ছুটে আসে তাদের প্রতি। উপস্থিত জনসাধারণের ধারণা তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলে তারা বোধহয় ভাগ্য ফিরে পাবে। ভাড়া করা ইন্ডিয়ানদের দ্বারা সভা পরিপূর্ণ। সাধারণ জনগণ সবাই খালি পায়ে মরুভূমির মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কারোর জন্য কোন দুঃখ অনুভব করলেন না তিনি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে জনগণকে থামিয়ে দিলেন। কোনো প্রকার কোনো অঙ্গভঙ্গি না করেই কিছুটা রাগান্বিতভাবে বক্তব্য দিতে শুরু করলেন তিনি। সামনের সমুদ্রের দিকে আটকে আছে তাঁর চোখ। প্রচন্ড গরমে বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সমুদ্র। সিনেটরের মুখস্ত কথাগুলো জনগণের মধ্যে জল ঢেলে দিল। এরকম কথা আগেও অনেক বার বলেছেন তিনি। সত্যকথা বেশিবার বলার কারণে সেগুলো এখন মিথ্যার মতো শোনায়। মারকাস অরলিয়াসের ধ্যান নামক বইয়ের চার নম্বর উপসর্গ থেকে তিনি পাঠ করতে থাকেন, ‘এখানে আমরা জড়ো হয়েছি প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।’ কণ্ঠে জোর এনে পটানোর সুরে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমরা একে উপরের সঙ্গে নিজেদের দেশে বহিরাগতদের মতো ব্যবহার করবো না। এই খারাপ আবহাওয়ার রাজত্বে আমরা যেন নিজেদের দেশে নিজেরাই নির্বাসিত। সত্যি সত্যিই এখন আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে নতুন জাতি হয়ে উঠবো। সমবেত সুধী, এবার আমরা অবশ্যই মহৎ ও সুখি জাতি হবো।’
তাঁর এইসব কথাবার্তায় মধ্যে এক মজার ঘটনা ঘটে। তিনি যখন কথা বলেন তার চামচারা কাগজের নকল পাখি আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারে। মুহূর্তে সেগুলো ডানা মেলে জীবন পেয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়। মঞ্চ থেকে পাখিগুলো সাগরের দিকে চলে যায়। একই সময়ে অন্য কিছু মানুষ নকল সবুজ পাতা লাঠিতে লাগিয়ে মঞ্চের চারপাশে খরার জমিতে রোপন করছে।  জনগণের চোখের আড়ালে কাজগুলো সম্পন্ন করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে কার্ডবোর্ডে তাদের ভবিষ্যৎ বাড়ি কেমন হবে ঠিক তেমন একটা নকশা প্রদর্শিত হল। সেটা ছিল লাল রঙের, ও জানালা ছিল বড় কাচের। পুরাটা ছিল বেশ জীবন্ত। তারা সেসব বাড়িতে থাকে ঠিক সেরকমটা নয়। পুরো ব্যাপারটা জনগণের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলল।
দুটো ল্যাটিন কোটেশন ব্যবহার করে বক্তৃতা শেষ করলেন সিনেটর। এতে করে বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে শেষটা। তিনি বললেন বৃষ্টি নামানোর মেশিন দেবেন। পশুর জন্মানোর সম্ভাবনার কথা বললেন। তিনি আরো বললেন, সুখের তেলের কথা যার ফলে এই খরার জমিতেও ভালো ফসল ফলবে, জানালাগুলোতে প্যানসি ফুলে ফুলে ভরে উঠবে। তিনি দেখলেন তার কল্পনার জগত তারই মনের মতো করে সাজানো। ঠিক তখনই তিনি জনগণের দিকে আঙুল তুলে বেশ জোরেই সঙ্গে বললেন, ‘ঠিক এমনই হবে সব। হ্যাঁ, সমবেত ভদ্রমহাদয়গণ এমনটিই আমার ভাবনা।’
আমজনতা পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। কাগজে সমুদ্র অঙ্কিত করে সেটা মুড়িয়ে বড় ধরনের একটা গাড়ি বানানো হয়েছে। গাড়িটি শহরের সবচেয়ে বড় বাড়িটির থেকেও লম্বা। কল্পিত সেই নকল শহরে বুক উঁচু করে সেটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। একমাত্র সিনেটরই খেয়াল করলেন যে, সেই কাল্পনিক কার্ডবোর্ডের শহর এবং বড় গাড়িটি শহরের এমাথা থেকে ওমাথা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বাজে আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে সেটি আর আগের মতো নেই। আর এতে করে তার কল্পিত শহরকে রোজেল ডেল ভিয়েরির বাকি সব বাড়ির মতো ধুলিধূসর ও করুণ দেখাচ্ছে।
গত বারো বছরের মধ্যে এই প্রথম নেলসন ফারিনা সিনেটরের মিটিংয়ে যাননি। নিজের বাড়ির অকল্পিত ছত্রছায়ায় দুপুরের ঘুমের ফাঁকে দোলনায় শুয়ে শুয়ে সিনেটরের বক্তৃতা শুনছেন। যে ওষুধের দোকানের মালিক নেলসন ফারিনাকে বাড়ি বানাতে সাহায্য করেছিল তার সঙ্গেই ভাগ করে নিয়েছিল তার স্ত্রীকে। ডেভিল আইল্যান্ড থেকে যেদিন তিনি রোজেলডেল ভিয়েরিতে পালিয়ে এসেছিল সেদিন তার হাতে ছিল এক গাদা পাখি। সঙ্গে ছিল অতি রূপসী এক কালো মেয়ে। মেয়েটিকে  সে পেয়েছিল প্যারামারিবুতে। পরবর্তীতে এই মেয়েটির গর্ভেই জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। কিছুদিন পর তার মায়ের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মেয়েটার ভাগ্য ভালো ছিল খুব। কারণ এর আগে জন্ম নেওয়া অন্য মেয়েদের শরীরের সারে তার ফুলকপির বাগান সমৃদ্ধ হয়েছিল। সেইসব মেয়েদের নিজেই কবরস্থ করেছিল সে। তার মেয়েটি লোকাল ডাচ নাম নিয়েই বেশ সম্মানের সঙ্গে বড় হচ্ছে। তার মায়ের রঙ ও রূপ পেয়েছে মেয়েটা। চোখগুলো বাবার মতো হলুদ বিস্ময়ে ভরা। এই নিয়ে বাবার গর্বের শেষ নেই। তিনি যে পৃথিবীর সবচাইতে মূল্যবান রূপসী মেয়েকে বড় করছেন এ বিষয়ে তার কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

 

সিনেটর ওনেসিমো সানচেযের সঙ্গে দেখা হওয়া প্রথম নির্বাচনী শোভাযাত্রা থেকেই নেলসন ফারিনা তাকে অনুরোধ করেই চলেছে তিনি যেন তাকে একটি নকল আইডেনটিটি কার্ড দেন। ওটা দেখিয়ে সে নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারবে। আইন তাকে কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু সিনেটর তাকে বন্ধুসুলভভাবে এই আবেদন নাকচ করে দেন। নেলসন কিন্তু হার মেনে থাকেনি। এরপর যতবারই সিনেটরের সঙ্গে নেলসনের দেখা হয়েছে সে বারবারই একই অনুরোধ করে আসছে। ইনিয়ে বিনিয়ে ওই একই কথা। তবে এবারে সে নিজে যায়নি। নিজের হ্যামোকে শুয়ে আছে। সেখানে শুয়ে শুয়ে সে সিনেটরকে অভিসম্পাত দিচ্ছে। জলদস্যু বলে গালাগালও করলো সে। সিনেটরের বক্তৃতা, জনগণের হাতের করতালি, কাগজের পাখি, কার্ডবোর্ড শহর আর বড় গাড়ি সবকিছুই কথা সে তার হ্যামোকে শুয়ে শুনতে পাচ্ছে। এসব দেখে শুনে আকাশের দিকে থুতু ছুঁড়ে মারে নেলসন ফারিনা। নিজের আঞ্চলিক ভাষায় বিড় বিড় করে গাল পাড়ে।
বক্তৃতার পর সিনেটর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য হাঁটতে বের হন শহরের ভেতর। পিছে পিছে বাদ্যবাজনাও বাজতে থাকে। শহরের লোকেরা তাদের সমস্যার কথা বলে। সিনেটর মনোযোগ দিয়ে সেসব কথা শোনেন। এবং প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু সান্ত¦নার বাণী রাখেন তিনি। কোনো সাহায্যের কথা না বলেও চমৎকারভাবে তিনি সবাইকে শান্ত করতে পারেন। ছাদের উপর একজন মহিলা তার ছয় সন্তান নিয়ে এই গোলমালের মধ্যেও চিৎকার করে সিনেটরের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সার্মথ্য হয়। চিৎকার করে সে বলে, ‘আমি বেশিকিছু চাই না সিনেটর। শুধু একটা গাধা হলেই চলবে আমার। দূরের কুয়া থেকে পানি আনার জন্য গাধা আমার খুব প্রয়োজন।’
সিনেটর তার রোগাপটকা সন্তানদের দিকে তাকিয়ে মহিলাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তোমার স্বামীর খবর কী ?’ কণ্ঠে একটু রসিকতা এনে মহিলাটা জবাব দিল,
: স্বামী আমার ভাগ্য অন্বেষণে আরুবা দ্বীপে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি পেয়েছেন একটি বিদেশি সুন্দরী মেয়ে। সুন্দরীটি নাকি দাঁতে হীরে পরে।
এই কথাতে চারিদিকে হাসির রোল পড়ে গেল। সিনেটর বললেন,
: ঠিক আছে। তুমি গাধা পাবে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে সিনেটরের লোকজন গাধা এনে মহিলাটির বাসায় পৌঁছে দেয়। গাধাটির সারা গায়ে নির্বাচনী প্রচার ও পার্টির নাম এবং ভোট দেবার কথা লেখা। গাধাটার গায়ে এমনভাবে কালিতে লেখা যে অনেকদিন যাবত মানুষ বুঝবে এটা সিনেটরেরই দেওয়া উপহার।
ঘুরতে ঘুরতে একজন অসুস্থ বুড়োর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সিনেটরের। বুড়োটার বিছানা একেবারে দরজার সামনে যাতে সে সিনেটরকে দেখতে পায়। তাকে দেখেই সিনেটর এক চামচ ওষুধ খাওয়ালেন। একেবারে শেষ মাথা যেখানে কার্ডবোর্ডের বেড়া শেষ হয়েছে ওখানটাই নেলসেন ফারিনাকে দেখতে পেলেন ওনেসিমো সানচেয। ফারিনা তার হ্যামোকে শুয়ে আছে। দেখতে বেশ বিষন্ন লাগছে তাকে। খুব বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে সিনেটর তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। ফারিনা তার নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় বলল সে ভালো নেই। বাবা ও সিনেটরের মধ্যে কথার আওয়াজ শুনে ফারিনার মেয়েটি ঘর থেকে বের হয়ে এলো উঠোনে। তার পরণে সস্তা ভারতীয় গুজারিও ঢিলে পোশাক। চুলগুলো রঙিন ফিতে দিয়ে সাজানো। মুখটা এমনভাবে পালিশ করা যাতে সূর্যের তাপ না লাগে। এই অদ্ভুত সাজের মধ্যেও সিনেটরের চিনতে ভুল হয় না যে, মেয়েটি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুন্দরী। মেয়েটিকে দেখে সিনেটরের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়।
: পাগলামির বশে এ তুমি কী সৃষ্টি করেছো ঈশ্বর ! এ মেয়ে তো আমাকে শেষ করে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
ওই রাতেই নেলসন ফারিনা সবচেয়ে ভালো পোষাকে সজ্জিত করে সিনেটরের কাছে পাঠালেন মেয়েকে। রাইফেল সমেত দুইজন দেহরক্ষী মেয়েটিকে ভবনের একটি কক্ষে একটি মাত্র চেয়ারে বসতে দিল। পরের রুমে সিনেটর রোজেলডেল ভিয়েরির গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছেন। বক্তৃতার যেসব সত্য অংশ বাদ পড়েছে সেসব কথা বলার জন্যই এই আয়োজন। মরুভূমির এসব অঞ্চলের লোকদের সঙ্গে এরকম বিষয় নিয়ে প্রায়ই কথা বলে থাকেন তিনি। এসব কথা বলতে বলতে একঘেয়েমি ও ক্লান্তবোধ হয় তাঁর। সমস্ত শরীরসহ গায়ে শার্ট ভিজে জবজবে অবস্থা। ইলেকট্রনিক ফ্যান থেকে গরম বাতাস এসে তাকে শীতল করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। ফ্যানের বাতাস ও ঘরের গরম দুটো মিলে যে শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে সেটা একটা বড় মাছির ভনভন শব্দ বৈ আর কিছুই নয়। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন-
: কাগজের তৈরি পাখি আমরা কেউ অবশ্যই খেতে পারি না। না আপনারা, না আমি। আমি ভালো করেই জানি যে, যেদিন এইসব ছাগলের নাদির উপর সবুজ গাছপালার জন্ম হবে সেদিন পুকুরের পানিতে পোকার বদলে দেখবেন বড় বড় মাছ। আমি ও আপনাদের তখন কোনো মিটিংয়ের দরকার হবে না আর। আমি কী বলতে চাচ্ছি আপনাদের কাছে নিশ্চয় সেবিষয় পরিষ্কার।
কেউ কোন উত্তর দিল না। কথার ফাঁকে ফাঁকে সিনেটর দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তা দিয়ে প্রজাপতি বানালেন। এরপর তা লক্ষ্যহীনভাবে বাতাসে উড়িয়ে দিলেন। ফ্যানের বাতাসে প্রজাপতি উড়তে উড়তে অর্ধেক ভিড়ানো দরজার ফাঁক দিয়ে দূরে চলে গেল। মৃত্যুর জটিল চিন্তায় নিজেকে আয়ত্বে এনে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি,
: আমার পুনরাবৃত্তি করার কোন দরকার ছিল না। আপনারা সবই জানেন। শুধু আপনাদের দরকারেই আমি পুননির্বাচন করতে চাই। আমি এসব এঁদো ডোবার পচা পানি দেখতে দেখতে ফেডআপ। আরো বীতশ্রদ্ধ হয়েছি গরীব ইন্ডিয়ানদের ঘামের গন্ধ শুঁকে শুঁকে। অন্যরা এসব পুঁজি করে টাকা বানাতে পারে। কিন্তু আমার দিয়ে এসব হবে না।’
কাগজের প্রজাপতি উড়ে এসে লরা ফারিনার সামনে এসে পড়ল। শুধুমাত্র ফারিনাই এটা দেখতে পেল। কারণ প্রহরীরা বন্দুক আঁকড়ে প্রবেশমুখে গভীর ঘুমে পড়ে রয়েছে। প্রজাপতি উড়তে উড়তে দেয়ালে আটকে গেল। দেয়ালে আটকে যাবার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল তার পাখা। নখ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেটা তুলতে চেষ্টা করে লরা ফারিনা। পাশের রুমের করতালির শব্দ শুনে প্রহরীর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে সে লরা ফারিনার দেয়াল থেকে প্রজাপতি তুলবার বৃথা চেষ্টা দেখতে পায়। ঘুম জড়িত কণ্ঠে প্রহরী লরাকে জানায়,
: ওটা উঠবে না। ওকে দেয়ালে আঁকা হয়েছে।
মিটিং শেষে লোকজনকে বের হওয়া দেখে লরা ফারিনা মাটিতে বসে পড়ে। দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সিনেটর। দরজার প্রবেশমুখ খালি হলে লরা ফারিনাকে দেখতে পান সিনেটর।
: এখানে কী করছো তুমি ?
মেয়েটি তার আঞ্চলিক ভাষা গুজিরোতে উত্তর দিলেও বুঝতে পারে সিনেটর। ভালো করে তাকাতেই ঘুমন্ত প্রহরীকে দেখতে পান সিনেটর। কিন্তু লরা ফরিনার রূপে এতো বেশি মুগ্ধ হয়ে যান তিনি যে প্রহরীর কথা প্রায় ভুলেই গেলেন। সিনেটরের বেদনার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী এই মেয়েটির অসামান্য সৌন্দর্য। ঠিক সেই মুহূর্তে মৃত্যুর চিন্তায় তাঁকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করলো।
: ভেতরে এসো। মেয়েটিকে ডাকলেন তিনি।
দরজার সামনে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লরা ফারিনা। প্রজাপতির মতো পাখা ঝাপটিয়ে হাজার হাজার টাকা মনে হলো তার সামনে উড়ছে। ফ্যান বন্ধ করতেই টাকাগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সিনেটর  হাসতে হাসতে বললেন,
: দেখতে পাচ্ছো ? এভাবে এমন কী মানুষের গুও বাতাসে উড়তে পারে।
স্কুলের বাচ্চাদের একটি টুলে বসে লরা ফারিনা। মসৃণ ও টান টান ওর গায়ের চামড়া। তেলতেলে। বাচ্চা ঘোড়ার কেশরের মতো চুলগুলো। বাতির চেয়েও উজ্জ্বল তার বড় বড় চোখ। নোনা ধরে ছিঁড়ে যাওয়া গোলাপকে সিনেটর দেখতে পেলেন মেয়েটির দৃষ্টি দেখেই।
: এটা একটি গোলাপ। তিনি বললেন। একটু জড়তার সঙ্গে সে বলল
: আমি জানি। এবং এও জানি রিওহাচাতে এটাকে কী বলে।
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সৈনিকের খাটে বসে বসে গোলাপের গল্প বলেন সিনেটর। হার্টের কাছের বোতামগুলোই তিনি খুলতে থাকেন। সেখানে অঙ্কিত তীরবিদ্ধ হৃদয়ের ছবি। ভেজা শার্ট খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলেন তিনি। লরা ফারিনাকে বুটজুতো খুলতে সাহায্য করতে বললেন। মেয়েটি খাটের দিকে মুখ করে হাঁটুমুড়ে বসে। এরপর মেয়েটি যখন তার বুটজোড়া খুলছে সিনেটর তখন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। মেয়েটির রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি ভাবতে থাকেন, এই সাক্ষাতে কার কপাল যে পুড়বে ! মেয়েটিকে সিনেটর বললেন,
: তুমি তো দেখছি একেবারে বাচ্চা।
: একদম বিশ্বাস করবেন না জনাব। আগামী এপ্রিলে আমার বয়স হবে ঊনিশ।
সিনেটর এবার নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞাসা করলেন,
: কত তারিখ ?
: এগারো। মেয়েটি বলল।
এই কথা শুনে বেশ মজা লাগে সিনেটরের। তিনি হাসতে হাসতে বলেন,
: দেখছো আমাদের দুজনেরই গ্রহ আরিস। এ হলো একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার রাশি।
লরা ফারিনা যেন এসব গুরুত্বই দিচ্ছিল না। সে তখন বুটজুতো খোলা নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী করবে এখন। ওদিকে সিনেটরও বুঝতে পারছেন না লরা ফারিনাকে নিয়ে এখন তিনি করবেনটা কী। এরকম হঠাৎ ভালোবাসায় তিনি অভ্যস্থ নন। মেয়েটির অতীতের কলঙ্কময় জন্মের ইতিহাসও তিনি জানেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি একটু ভেবে ফারিনাকে দুপায়ের মধ্যে রেখে বাহু ধরে খাটের উপর শুইয়ে দিলেন। মেয়েটি পিঠের উপর ভর করে বিছানায় শুয়ে থাকে। এরপর সিনেটর লক্ষ্য করলেন জামার নীচে সে কিছুই পরেনি। মেয়েটির শরীর থেকে ঘন কালো আদিম প্রাণীদের মতো এক ধরনের গন্ধ নাকটাকে ঝাঁঝিয়ে দিল সিনেটরের। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সিনেটর বললেন,
: আমাকে কেউ ভালোবাসে না।
লরা ফারিনা কিছু একটা বলতে গিয়ে গলায় আটকে ফেলে, কারণ ওই ঘরের ভেতর যে বাতাস তাতে করে কোনরকম নিঃশ্বাস নেওয়া যায় শুধু। মেয়েটা যাতে তাঁকে সাহায্য করতে পারে সেইজন্যে পাশে শুইয়ে দিলেন তিনি। ঘরের আলো নেভাতেই চারপাশ গোলাপের ছায়ায় ভরে উঠল। ভাগ্যের উপর নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া ফারিনার আর কিছুই করার নেই এই মুহূর্তে। খুব ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সিনেটর। হাতের স্পর্শে মেয়েটাকে কাছে টানে। কিন্তু যেখানে ফাইনালি   মেয়েটাকে খুঁজে পাবেন বলে ভেবেছিলেন ঠিক সেখানে লোহার মতো শক্ত কিছু একটা হাতে ঠেকল।
: কী পরেছো এখানে তুমি ?
ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করেন সিনেটর।
: তালা দেওয়া জাঙ্গিয়া। মেয়েটি জবাব দিল।
উত্তেজিত হয়ে সিনেটর বললেন,
: কোন্ নরকের সন্ধানে এ কাজ করেছো তুমি ? চাবি কোথায়?
লরা ফারিনা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
: আমার পাপার কাছে। পাপা বলে দিয়েছেন আপনার কোন একজন লোক পাঠালেই হবে তার কাছে। কিন্তু তার আগে আপনি তাকে লিখিতভাবে একটা চিঠি দিবেন যাতে করে সে নিরাপদে বসবাস করতে পারে।
সিনেটর উত্তেজিত হয়ে বললেন,
: শালা ব্যাঙের জারজ বাচ্চা।
এরপর বিড়বিড় করে চোখ বন্ধ অবস্থায় কী যেন বলতে বলতে ভাবতে থাকেন। অন্ধকারের ভেতর তিনি শুনতে পান, ‘এটা স্মরণে রেখো তুমি কিংবা অন্য যে কেউ যার খুব বেশিদিন নেই মারা যেতে, তারপরে খুব বেশিদিন কেউ তোমার নাম মনে রাখবে না।’ এই ঐশী বাণী চলে যাবার আগ পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেন।
: একটা কথা বলো তো আমাকে। আমার সম্পর্কে তুমি কী কী শুনেছো ?
: সত্যিই আপনি খাঁটি সত্য জানতে চান ?
: হ্যাঁ, একেবারে খাঁটি সত্য।
: ঠিক আছে আমি বলছি আপনার সম্বন্ধে কী কী শুনেছি। সবাই বলাবলি করে আপনি নাকি খুব খারাপ লোক। আপনি নাকি আগের সবাই চেয়ে আলাদা।
সিনেটর একথা শুনে একদম মন খারাপ করলেন না। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকেন। যখন চোখ খুললেন মনে হল যেন কোন এক গভীরতম বোধ থেকে এইমাত্র ফিরে এসেছেন তিনি। চিৎকার করে উঠে তিনি বললেন,
: ওহ্ কী নরক ! তোমার কুত্তার বাচ্চা পাপাকে বলো আমি তার সবকিছু ঠিকঠাক করে দেবো।
ভয়ে ভয়ে লরা ফারিনা তাঁকে বলল,
: আপনি চাইলে আমি নিজে গিয়ে চাবিটা নিয়ে আসতে পারি।
সিনেটর তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
: চাবি চুলোয় যাক। ভুলে যাও। একটুখানির জন্যে আমার পাশে ঘুমাও। একাকী নিঃসঙ্গ মানুষের খুব ভালো লাগে যদি কেউ তাদের পাশে ঘুমিয়ে একটু সঙ্গ দেয়।
লরা তার নিজের কাঁধে সিনেটরের মাথা রাখে। গোলাপি চোখে চেয়ে থাকে। মেয়েটির কোমর দুহাতে জড়িয়ে ধরে সিনেটর। মুখ ডুবিয়ে ঘষতে থাকে সেই আদিম প্রাণীর হাতের তলে। মেয়েটির ভয়ের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। ঠিক এভাবেই তিনি মারা যেতে চান ছয়মাস এগারো দিন পর। তাঁকে জড়িয়ে লোকজন লরা ফারিনার নানারকম কলঙ্ক রটাবে। কেউ কেউ আবার মেয়েটিকে ত্যাগ করতে চাইবে। তিনি তখন মেয়েটি ছাড়া একা মারা যাবার ক্ষোভে ফুঁপিয়ে কেঁদেই উঠবেন হয়তো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *