স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা: মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

Slider ঢাকা ফুলজান বিবির বাংলা
2 (3)
– ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম: ১৭ ই নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এ দিনে গোটা জাতিকে শোক সাগরে ভাসিয়ে উপমহাদেশের এ রাজনৈতিক সূর্য অস্ত গিয়েছিল। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। মজলুম মানুষের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বাংলার মজলুম জননেতা। তিনি তাঁর সারাটা জীবন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য ব্যয় করেছেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের জীবনে কখনো কোথাও মাথানত করেননি। আপোষহীন থেকেছেন নিজের আদর্শের প্রতি। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ছিলেন অবিচল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগরিত করেন। জমিদারদের নির্যাতন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক-মেহনতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। শুধু ব্রিটিশ নয়, পাকিস্তান স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি জীবনপণ লড়াই চালিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বস্তুতঃ তিনি জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ-চেতনার সংমিশ্রণে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন (ন্যাপ)। তাঁর বিচিত্র এই রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে- একটা কথা স্পস্ট বুঝা যায় যে, তিনি আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রামে কখনো পিছু হটেননি। বরং এই সকল লড়াই-সংগ্রামের জন্য জেল, জুলুম, হুলিয়াসহ নানা নির্যাতনের শিকার হন।
তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়ালাকুমুসসালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি । শেখ মুজিবুর রহমান এর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু ছিলেন মাওলানা ভাসানী। শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত অধিকারহারা মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রামী মহাপুরুষ ছিলেন মাওলানা ভাসানী। ভাসানী এমন একজন নেতা ছিলেন যাকে নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনে গবেষণা চলছে।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী  (জন্ম : ডিসেম্বর ১২, ১৮৮০-মৃত্যু : নভেম্বর ১৭, ১৯৭৬)  বাংলাদেশের অন্যতম রাজনীতিবিদ। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। যে কারণে যুক্ত ফ্রন্টের নামকরণ করা হয়েছিল ‘হক-ভাসানী’ যুক্ত ফ্রন্ট। এই হক ছিলেন, শের-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। দেশের মানুষের কাছে ‘মাওলানা ভাসানী’ ও ‘মজলুম জননেতা’ নামে অধিক পরিচিত। অসংখ্য ধর্মীয় ভক্ত বা মুরদি তাকেঁ শুধু ‘হুজুর’ বলেও সম্বোধন করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যদিও তিনি একান্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এদেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত , মেহনতি মানুষের মুক্তির দিশারী। বায়ান্নর আন্দোলনের ভাষা তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ এর সভাপতি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি কারাবরণ পর্যন্ত করেছিলেন। ৬৯ এর আন্দোলনেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তিনি যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা একেবারে ফেলে দেবার মত নয়।কৃষক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তিনি সবসময় রাজনীতি করেছেন অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানে তিনি উড়িয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতাকা।
দরিদ্র মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। নিতান্ত কিশোর বয়স থেকে তিনি নিয়েছিলেন সংগ্রামের দীক্ষা। তার ছোটবেলার একটি ঘটনা। কিশোর চেগা মিয়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এক বাড়িতে জেয়াফত খেতে গিয়েছেন। দরিদ্র মানুষসহ সবার জন্য সেখানে একই রকমভাবে বসে খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, খাঁ বাড়ির লোকজনের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়নি বলে সবাই চলে এলেও চেগা মিয়া বেঁকে বসেন। তিনি অন্য সবার সঙ্গে মাটিতে বসে জেয়াফত খান।এমনিভাবে মেহনতী মানুষের পক্ষে অবস্থান করে তিনি মজলুম জননেতায় উপনীত হতে পেরেছিলেন। ছোট বয়স থেকে তিনি শ্রমজীবীর কষ্ট উপলব্ধির জন্য সাধনা করেছেন। কৃষকের সঙ্গে চাষ করে, জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরে আয়-রোজগার করেছেন। কাজ করার মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন কৃষক, জেলে, কামার ও কুমারের বন্ধু। সারা জীবন ওই বোধই তাকে মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠায় অটল রেখেছে। দেওবন্দ মাদ্রাসায় ধর্মশিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক একদল আলেমের সংস্পর্শে আসেন। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এক সময় আসাম চলে গিয়ে কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানকার বিপ্লবীদের সঙ্গে দেওবন্দের মাওলানাদের চেতনার মিল দেখে তিনি এ রকম রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হন। বিপ্লবী রাজনীতি শুধু ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত নয়, তাদের সৃষ্ট জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মপন্থা এটি তাকে বিপ্লবীদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। পূর্ব বাংলায় তিনি কৃষকদের নিয়ে ইংরেজ শাসনের তাঁবেদার শোষকদের গোলা জ্বালিযে দেয়ার মতো অনেক ঘটনার জন্ম দেন। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী মওলানা নামে। মওলানা ভাসানীর বয়স যখন ৩০ বছর, ওই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন পূর্ববঙ্গ সফর করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন তার সার্বক্ষণিক সফরসঙ্গী। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছেন। তখন তিনি পরতেন পায়জামা ও পাঞ্জাবি। একদিন তার ধর্মীয় গুরু মাওলানা আজাদ সোবহানী বললেন, কৃষক শ্রমিক যা পরে তা না পরে তুমি কীভাবে তাদের বন্ধু হবে। সেই যে মওলানা ভাসানী লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা শুরু করেছিলেন আজীবন তা বহাল রেখেছেন। এ পোশাক পরেই তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেছেন, চীনে সরকারি সফরে গিয়েছেন। কংগ্রেস দিয়ে মওলানা ভাসানীর প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির শুরু। কংগ্রেস কর্মী হিসেবে তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল কৃষক-শ্রমিকের চিরশত্রু জমিদার, জোতদার আর সুদখোর মহাজন। এদের বিরুদ্ধে তিনি জনমত তৈরি করেছিলেন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার, জোতদাররা একাট্টা হয়ে তাকে খতম করে দিতে চেয়েছিল। তাই তিনি চলে যান আসামে। আসামে তার রাজনীতি দুর্বার গতি পায়।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। হাজী শারাফত আলী ও বেগম শারাফত আলীর পরিবারে ৪ টি সন্তানের জন্ম হয়। একটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে। মোঃ আব্দুল হামিদ খান সবার ছোট। তাঁর ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোট থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত ও দুই ছেলে মারা যায়। বেঁচে থাকলো ছোট শিশু আব্দুল হামিদ খান।
পিতৃহীন হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তাঁর আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তাঁর ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই ইদল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন হম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মাওলানা”। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
সাম্যবাদের আদর্শকে যিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, দেশের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের জন্য যিনি নিজের জীবনকে করেছিলেন উৎসর্গ তিনি হলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানীর জন্ম হয়েছিল এক সাধারণ পরিবারে ১৮৮০ সালে ১২ ফেব্র“য়ারি। বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানের জেলা) ধানগড়া গ্রামে।
জন্মের পর বাবা হাজী শরাফত আলী খান আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘চেগা মিয়া’। কিন্তু বাবা-মায়ের স্নেহ বেশিদিন পাননি মওলানা ভাসানী। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখনই পিতার মৃত্যু হয়। তারপর এগারো বছর বয়সে মায়েরও মৃত্যু হয়।
ভাসানীর আরও দুজন বড় ভাই ছিলেন আমীর আলী খান ও ইসমাইল খান। তাঁদেরও অকালমৃত্যু হয় একে একে। বেঁচে রইলেন বোন এবং ছোট ভাই আবদুল হামিদ খান ওরফে চেগা মিয়া। শৈশবেই সকলকে হারিয়ে আব্দুল হামিদ এসে আশ্রয় নিলেন চাচা ইব্রাহিম খানের বাড়িতে। চাচা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলেন সিরাজগঞ্জ শহরের এক মাদ্রাসায়। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসল না আব্দুল হামিদের। ক্লাসের বাধ্যবাধকতা তাঁর ভাল লাগত না। একদিন চাচার সাথে অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলেন শাহজাদপুরে এক দূঃসম্পর্কের ভগ্নিপতির বাড়িতে। সেখানে গিয়ে পড়াশুনা ছেড়ে শুরু করলেন ক্ষেতমজুরের কাজ। ভাসানী যখন শাহজাদপুরে ক্ষেতমজুরের কাজ করেছিলেন তখন সেখানে এসে হাজির হলেন এক পীরসাহেব। তিনি এসেছেন সুদূর ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে। নাম তাঁর নাসিরউদ্দিন শাহ বোগদাদী। ভাসানী একদিন দেখা করলেন পীর সাহেবের সাথে। পীর সাহেবের এই অনাথ বালকটিকে পিতৃস্নেহে কাছে টেনে নিলেন। পরে পীরসাহেবের সাথেই তিনি চলে গেলেন ময়মনসিংহ জেলার বল্লাগ্রামে। সেখানে গিয়ে পীর সাহেবে ভাসানীকে আবার মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন।
মক্তবের পড়া শেষ করে শুরু করলেন শিক্ষকতা। মাদ্রাসার শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে এলেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। এখানে বছরখানেক থাকার পর তিনি পীরসাহেবের সাথেই চলে গেলেন আসামে। পীরসাহেবের আস্তানায়। তখন সারা ভারতে চলছিল ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। ভাসানীও জড়িত হলেন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে। তখন ভারতের বর্তমান উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ভাসানী পীর সাহেবের অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন দেওবন্দে। ভর্তি হলেন দেওবন্দ ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি চলল তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড। বলতে গেলে দেওবন্দ থেকেই ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের শরু। দেওবন্দের শিক্ষা শেষ করে ভাসানী আবার ফিরে এলেন আসামে।
মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য পীরসাহেব তখন আসামের জঙ্গলে স্থাপন করেন ইসলাম প্রচার মিশন। ভাসানীও তখন মিশনের কাজে আত্মনিয়োগ দেন। মিশনের কাজ নিয়ে তিনি চলে এলেন বগুড়া পাঁচবিবিতে। এখানে পরিচয় হল জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর সাথে। ভাসানী জমিদার সাহেবের ছেলে মেয়েদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন। পরে শুধু গৃহশিক্ষকতা নয়, জমিদারী দেখাশোনা করারও দায়িত্ব পেলেন ভাসানী। জমিদারি সংক্রান্ত ব্যাপারে ভাসানীকে প্রায়ই কলকাতায় যাতায়াত করতে হত। কলকাতা তখন ছিল বিপ্লবী দলের কিছু কর্মী সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন উপলক্ষেই ভাসানী দেশবন্দু চিত্তরঞ্জন দাসের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। ভাসানী তখন থেকেই দেশবন্ধুর অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালেই ভাসানী অনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং অসহযোগী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনে নেমে গ্রেফতার হন। তাঁর নয় মাসের জেল হয়। এটাই ভাসানীর প্রথম কারাবরণ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯২১ সালে তিনি আলিভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মওলানা মোহাম্মদ আলি এবং শওকত আলির ডাকে খেলাফত আন্দোলন এবং একই সাথে দেশবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করলেন। আবারও গ্রেফতার হলেন তিনি। এবার হল সাতদিনের জেল। ১৯২২ সালে উত্তর বঙ্গ ও আসামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন ভাসানী। কলকাতা থেকে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষ বসুসহ আরও অনেকে। ভাসানী এইসব জাতীয় নেতার সাথে দুঃস্থ মানুষের সেবায় দিনরাত কাজ করতে লাগলেন।
১৯২৫ সালে তিনি বগুড়ার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরীর কন্যা আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। বিয়ের একবছর পর তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যান আসামের ভাসানচরে। ১৯২৬ সালে তিনি আসামে শুরু করেন ‘কৃষক আন্দোলন’।
জমিদাররা প্রমাদ শুনলেন। তখন সব জমিদার মিলে ইংরেজ গভর্নরকে দিয়ে মওলানা ভাসানীকে অবাঞ্চিত ব্যক্তি ঘোষণা করলেন। ভাসানীকে বাংলা থেকে বহিষ্কার আদেশ জারি করা হল। অবশেষে ভাসানী স্ব-পরিবারে গিয়ে ঠাঁই নিলেন আসামের গহীন জঙ্গলে-ঘাগমাড়া নামে এক জায়গায়। সাংগঠনিক কাজের জন্য মাঝে মাঝে কলকাতা বা অন্যান্য জায়গায় যেতে হলেও ভাসানী ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লাগাতারভাবে আসামেই ছিলেন।
তিনি ১৯২৯ সালে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখোলা ময়দানে ‘বঙ্গ আসাম প্রজা সম্মেলন’ আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে প্রায় তিন লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
মওলানা ভাসানী লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন ১৯২৫ সালে। ১৯৩৭ সালে ভাসানী আসামের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আসামের বারোটি জেলায় মুসলিম লীগের সংগঠন আরও জোরদার হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেই আসামের ৩৪ আসনের মধ্যে ৩১ টি আসন লাভ করে। ভাসানী নিজেও আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগের মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হওয়ার পরও ভাসানী তাঁর লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। ফলে সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেন্দ্রীয় লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁকে নিজদলীয় সরকারের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু ভাসানী তার আর্দশের প্রতি অটল রইলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি রংপুরে গাইবান্দায় কৃষক প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করলেন।
১৯৪০ সালে তিনি জননেতা এ কে ফজলুল হকের সাথে মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন।
আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে থাকার জন্য স্বয়ং মুহম্মদ আলি জিন্নাহ পর্যন্ত তাঁকে অনুরোধ করেন। কিন্তু জিন্নাহর প্রস্তাবও ভাসানী প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ভাসানীর আন্দোলনের মুখে ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আসামের মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। তবে পুলিশ বাঙালীদের ওপর গুলি চালায় এবং একজন নিহত হয়। ভাসানী গ্রেফতার হন।
১৯৪৭ সালের ২৯ জুন ভাসানী গৌহাটি কারাগার থেকে ছাড়া পেলেন। ছাড়া পেয়েই তিনি ছুটে এলেন সিলেটে। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহুর্তে সিলেট পাকিস্তানের অংশ হবে কি না এই নিয়ে গণভোট হয়। ভাসানী সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্তকরণের পক্ষে সমর্থন করেন। এই আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট ভারত বর্ষ দ্বিখন্ডিতহয়ে জন্ম নিল দু’টি পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম সরকার মওলানা ভাসানীকে অবিলম্বে আসাম ত্যাগের নির্দেশ দেয়। তিনি ফিরে এলেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। ১৯৪৮ সালে প্রথম পূর্ববঙ্গ পরিষদের টাঙ্গাইল আসন শূন্য হলে ভাসানী উপনির্বাচনে অংশে নেন এবং খাজা নাজিম উদ্দিন মনোনিত প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু খাজা নাজিম উদ্দিন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই উপনির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত যাতে ভাসানী কোন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে এই মর্মেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৯৪৯ সালে সোহ্রাওয়াদী ঢাকায় ফিরে এলে মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভাসানী একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। ১৯৫৪সালে বার্লিনে শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভাসানী লন্ডন সফরে গেলেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তান সরকারের চক্রান্তের ফলে জার্মানি যাবার ভিসা পেলেন না। তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় শুনতে পারলেন পূর্ববঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করা হয়েছে এবং যুক্তফ্রন্ট নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাই সেই মুহূর্তে তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। পরে ১৯৫৫ সালে সোহরাওয়ার্দি ভাসানীকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কাগমারি সম্মেলন। ভাসানীর উগ্যোগে এই কাগমারি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। ভাসানীর সেই কাগমারি সম্মেলনের ফল বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন শেখ মজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্ব একটি রাজক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে কাগমারি সম্মেলনের ১৪ বছর পরে পাকিস্তান সরকার ভেঙে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মলাভের মাধ্যমে। সেই বছরই ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করে নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আ্ওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভাসানী হলেন চিনপন্থি ন্যাপের সভাপতি অপর দিকে মস্কোপন্থি ন্যাপের সভাপতি হলেন অধ্যাপক মুজাফর আহমদ। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে সারা দেশে গড়ে ওঠে আন্দোলন। ভাসানীও এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরীক হন। আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্র“য়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু বের হয়ে আসার পর আইয়ুবিরোধী তথা পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন আরও জোর দার হয়। এই আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক ছিলেন মওলানা ভাসানী।

১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭-এ মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। সেই সময়ে আসামে ‘লাইন প্রথা’ চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। এসময় তিনি ” আসাম চাষী মজুর সমিতি” গঠন করেন এবং ধুবরী, গোয়ালপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলীম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে “বাঙ্গাল খেদাও” আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটি সহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেফতার হন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে। এখানে উলেস্নখ যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ৰমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মিসম্মেলনে যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন। ১৯৫০ সালে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মাওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্ম যান এবং সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে এবং মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫-র ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন। একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন। কাগমারী সম্মেলনে১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে।এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতিএর সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৭-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।

বন্দী অবস্থায় ১৯৬২-র ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দ্বায়িত্বভার গ্রহন করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন। ১৯৬৭-র ২২ জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন।  ১৯৬৭-র নভেম্বর-এ ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন। ৮ মার্চ (১৯৬৯) পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন।

১৯৭০ সালের ৬-৮ আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন।অতঃপর সাধারণ নির্বচনে অংশ গ্রহনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রান ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারী ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন।২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িযে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পাকিস্তান বাহিনী তার সনত্দোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। পরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাট তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পৰে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যেন পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রৰার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু’বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন_ ১) তাজউদ্দীন আহমদ, ২) মণি সিং, ৩) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ৪) মনোঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লী ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করেন যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে দিল্লী অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল।  বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন।  ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।

মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধঃ
মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশের কিংবদন্তীতুল্য প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং ষাটের দশকের শুরুতেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আমরা থাকতে পারছি না। ১৯৭০ সালে ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে মাওলানা ভাসানী অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের হাতে হস্তান্তরে গড়িমসি করতে লাগলেন তখন মাওলানা ভাসানী বজ্র কন্ঠে বললেন ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাই বলি অনেক হইয়াছে কিন্তু আর নয়’।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন প্রদান করে এবং বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা ঘোষণার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী বাঙ্গালীদের ওপর আক্রমন করলে তিনি ভারতে চলে যান। যুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি এসময় বিশ্বনেতাদের কাছে চিঠি লিখেন। মওলানা ভাসানী চীনের নেতা চেয়ারম্যান মাও সেতুং , প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান।
১৯৭১ সনের ২১ শে এপ্রিল মওলানা ভাসানী বহু কাকুতি মিনতি করে চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইয়ের নিকট মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য পত্র লেখেন

ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস

১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এ দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এ দিন দেশের সর্বস্তরের লাখো জনতা লংমার্চে অংশ নেন।

ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢলনামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারতবিরোধী বিভিন্ন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা এলাকা। বেলা ২টায় হাজার হাজার মানুষের স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাত যাপনের জন্য সে দিনের মতো শেষ হয়। মাঠেই রাত যাপন করার পর দিন সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে।

ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এ লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পান না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন ভারত সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন এবং নিরাপত্তা জোরদার করে।

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা মার্চের প্রস্তুতির সময় বিশ্ব নেতাদের এ সম্পর্কে অবহিত করে বার্তা পাঠান। তিনি তদানীন্তন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড, চীনের নেতা মাও সেতুং, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন প্রমুখের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে ভারতের ওপর প্রভাব খাটিয়ে গঙ্গার পানি বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন।

এ ছাড়া মওলানা ভাসানী জনসভা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফারাক্কার ফলে বাংলাদেশে এরই মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তা সরেজমিন দেখতে আসার আহ্বান জানান।

ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী সেদিন ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন তিকর দিক তুলে ধরে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সেই উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস্য হয়ে আছে আজও। ভারতের এক তরফা ও আগ্রাসী মনোভাবে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির মুখে। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা আজ পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধশত নদী বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে স্থান ভেদে ২৫ ফুট থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও কোনো সুফল আসেনি। দীর্ঘ দিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, পদ্মার বুকে বিশাল বালুচর পড়েছে। সেখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে, গাড়ি চলছে। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে। পদ্মার সেই যৌবন আর নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে, মরুকরণ দেখা দেবে।

মৃত্যু

জীবনের শেষ দিকে মওলানা ভাসানীকে ঘন ঘন হাসপাতালে যেতে হতো। হার্টের অসুখ, মূত্রাশয়ের অসুখ, ব্রঙ্কাইটিস তাকে কাবু করে ফেলেছিল। ১৯৭৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় এক মাস তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে ছিলেন। দেশে বেশ কিছুদিন সুস্থ ছিলেন। সন্তোষ থেকে ৪ নভেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকেও তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সবার প্রতি আহ্বান জানান । ১৯৭৬ খৃস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে।
সমাজ সংস্কার
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে। এছড়াও তিনি কাগমারিতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ এবং পঞ্চবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)
মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)
মাওলানা ভাসানী কর্ম-জীবনের শুরু থেকে সামাজিক জুুলুম, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। আমরা তাকে কখন দেখতে পেয়েছি বাংলা-আসামের স্থানে স্থানে জমিদার, সুদখোর শোষক মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে, কখনো বা উপনিবেশবাদী বৃটিশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায়, খিলাফত আন্দোলনে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, মাতৃভাষার দাবী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন আদায় এবং আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের আপোষহীন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতকে অভিন্ন নদীর উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণ থেকে বিরত রাখতে এবং বিশ্ববাসীকে এ বিষয়ে সচেতন করে বাংলাদেশের দাবীর প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৬ মে যে লং মার্চ‘র আয়োজন করেছিলেন তা ইতিহাসে আজ অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মাওলানা ভাসানী নেতৃত্বে ১৯৫২ সালে ৩০ জানুয়ারী ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরী হল রুমে বসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। সে কারণে তিনি ১৬ মাস কারা বরণের পর জনমতের কারণে তাকে সরকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরে তিনি ১৯৫৩ সালে ৩ ডিসেম্বর শেরে বাংলার একে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়াদীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন তার যোগ্য নেতৃত্বে পূর্ববাংলা পরিষদের নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তিনি মহান মুক্তিযোদ্ধ, বাংলা ভাষা, ফারাক্কা সহ গণতান্ত্রিক দাবী আদায়ের লক্ষ্যে অসহযোগ আন্দোলন সংগ্রামের ডাক দিয়ে দাবী আদায়ের বিভিন্ন সরকারকে বাধ্য করেছিলেন। আজ দেশের এই ক্রান্তি কালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মত জননেতা অত্যন্ত প্রয়োজন।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম , জিয়া পরিষদের সহ আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক, যুক্তরাজ্য ঝালকাঠি জেলা বিএনপির বিএনপির কার্যনির্বাহী সদস্য, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম আহবায়ক, জিয়া পরিষদের সহ আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সহ-সভাপতি,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষনা পরিষদের সিনিয়র সহ সভাপতি, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’র প্রতিষ্ঠিতা এবং চার্টাড ইনস্টিটিউট অব লিগ্যাল এক্সিকিউটিভের মেম্বার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *