বিতর্কিত ব্যবসায়ী বাদলের অর্থ পাচারের অনুসন্ধানে দুদক

Slider জাতীয়

 

dudok_604965195

 

 

 

 

ঢাকা: গোয়েন্দা সূত্রে অর্থ পাচারের তথ্য পেয়ে বিতর্কিত ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদলের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র এ বিষয়ে বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি জানায়, নেপালে বাদলের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটিতে অবস্থিত নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেডের (এনবি ব্যাংক) চেয়ারম্যান তিনি। ওই ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকটি বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের যৌথ বিনিয়োগে করা হয়েছে।

সবশেষ বাদল ব্যাংকটির পরিচালক হিসেবে নির্বাহী ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। গত ২৫ অক্টোবর আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে বাদলকে অপসারণ করা হয়। পরিচালনা পর্ষদের সভায় টানা অনুপস্থিতির পাশাপাশি নাশকতার মামলায় পুলিশের তদন্তে নাম আসায় তাকে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দুদকের কাছে থাকা তথ্য থেকে জানা যায়, বাদল বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তবে কোন দেশে অবস্থান করছেন তা প্রকাশ করতে চায়নি সূত্রটি।

জানা যায়, ‘ফুড চেইন এশিয়া লিমিটেড’ নামে তার খাবারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশসহ নেপাল, ভারত ও শ্রীলংকায় রয়েছে যার ফ্রাঞ্চাইজি।

দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে, এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বিদেশে টাকা পাচার করেন। যেসব বিদেশি নাগরিককে এ চেইন শপে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের প্রদর্শিত বেতনের চেয়ে কম বেতন দিয়ে অর্থ পাচার করছেন। ফ্রেড জুসটেন নামে এক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এদিকে লন্ডনে তার একটি বাড়ির তথ্য পেয়েছে দুদক। (যার ঠিকানা Flat 3, Audley Court, 32-34 Hill Street, London and trunk store number 3)। সূত্রের দাবি, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে তিনি লন্ডনে বাড়ি নিয়েছেন।

এসব সম্পদের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ’র কাছে চিঠি দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। নোটিশে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- নেপালে অবস্থিত এনবি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন আছে কিনা? থাকলে কি পরিমাণ বিনিয়োগ? বিনিয়োগ কীভাবে করা হয়েছে?

‘ফুড চেইন এশিয়া লিমিটেড’ নামে তার যে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে কিনা? এছাড়া লন্ডনে তার বাড়িতে বিনিয়োগের কোনো তথ্যসহ আরও কয়েকটি তথ্য চেয়ে বিএফআইইউ’র মহাব্যবস্থাপকের কাছে দুদক চিঠি পাঠায়। দুদকের এসব চাহিদার ভিত্তিতে বিএফআইইউ কাজ করছেন বলে জানা যায়।

দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, কিছু তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। দালিলিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নেপালের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এনবিবিএল-এর ৩২টি ব্রাঞ্চ। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর কামলাদি এলাকায়। এনবিবিএল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছে সাতজন। পর্ষদের চেয়ারম্যান বাংলাদেশের লুৎফর রহমান বাদল। ব্যাংকের ওয়েবসাইটেও তার ছবি রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন- শাহ আলম সারওয়ার, অরিজিত চৌধুরী, দীপক কারকি, মাধব প্রাসাদ নিউপেন, মুকুন্দ নাথ ডাঙ্গে ও অরুণ শ্রেষ্ঠ।

‘ফুড চেইন এশিয়া লিমিটেড’ এর ঢাকার বনানীতে দু’টি আউটলেট রয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানে সব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। একই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানি হওয়ায় এর মুনাফার বড় অংশ চলে যায় দেশের বাইরে। স্বাভাবিক মুনাফার চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ পাচার করা হয় বলে দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে মো. আরিমুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে গত মার্চ মাসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মো. আমিরুজ্জামানকে গ্রেফতার করে। চলতি বছরের মার্চ মাসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর) এ সাধারণ ডায়েরি করে (জিডি নম্বর-৯৯৯, তারিখ-২৪/০৩/২০১৫) আটক করে আমিরুজ্জামানকে। বাদলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত আমিরুজ্জামান। আমিরুজ্জামান ‘ফুড চেইন’ এর সিইও (চিফ অপারেশন অফিসার)।

নানা কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় ছিলো লুৎফর রহমান বাদলের নাম। শেয়ারবাজার থেকে ক্রীড়াঙ্গন, সব জায়গায় ছিলো তার বিচরণ। সবশেষ আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বাদলকে।

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবেও তিনি পরিচিত। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট গাজীপুরে একটি নাশকতার মামলায় তারেক ও বাদলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ (চার্জশিট) দেয় দুদক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বাদল পুঁজিবাজারে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থশালী হয়ে ওঠেন বলে মনে করা হয়।

অপরিচিত লতিফ সিকিউরিটিজের কর্ণধার হয়ে তিনি অল্প সময়ে বনে যান দেশের অন্যতম ধনকুবের। দুই বছরে জিএমজি এয়ারলাইন্স, ঢাকা ওয়েস্টিনসহ প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মালিক বনে যান লুৎফর রহমান বাদল। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিজনেস ক্যাপিটাল শেয়ার ও সিকিউরিটিজ, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, এলআর অ্যাগ্রো ফার্ম, ঢাকা-সাংহাই সিরামিক, আরটিভি ও নুরানী হিমাগার। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানকেই তিনি শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

২০০৬ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি প্রথম আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন। ২০১২ সালের ১১ জুলাই তিনি পুনঃনিয়োগ পান। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন।

জানা যায়, আইএফআইসি ব্যাংকে বাদলের ২ কোটি ৫৭ লাখ ৮৩ হাজার ৪১৬টি শেয়ার রয়েছে।

২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্তে গঠিত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্টে অভিযুক্তের তালিকায় তার নাম ছিল। অভিযুক্তের তালিকায় আরও ছিলেন বাদলের স্ত্রী সোমা আলম রহমান, বাদলের স্ত্রীর বড় ভাই আহসান ইমাম ও তার স্ত্রী  মেহজাবীন মোস্তফা ইমাম।

গত বছরের ৯ ডিসেম্বর তাকে ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সভাপতি ও পরিচালককে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের জের ধরেই তাকে আজীবন নিষিদ্ধ করে। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর বিকেএসপিতে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ এবং প্রাইম ব্যাংকের খেলা শেষে আম্পায়ারিং নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন।

তিনি তখন বলেন, ‘উনি মুখে অনেক কথায় বলেন কিন্তু উনার চাকুরে দিয়ে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করান। ওই  যে মল্লিক আছে না, তার চাকর সেই সবঠিক করে কে আম্পায়ার হবে আর খেলা কোথায় হবে।’

বিসিবির পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজনকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কলঙ্ক বলে অভিহিত করে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের মালিক এর আগে বলেছিলেন, ‘ও কোথায় নেই, বিসিবি পরিচালকের পদ থেকে শুরু করে ক্লাব কর্মকর্তা, কোচ সবখানে আছে, নেই শুধু বিসিবির অফিস সহকারী রুস্তমের পদে।’ এসব মন্তব্যের জেরে শেষ পর্যন্ত বিসিবিতে আজীবন নিষিদ্ধ হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *