বিদেশে পাচার ও আত্মসাৎ ৮২ কোটি টাকা

Slider জাতীয়

untitled-4_169750

 

 

 

 

 

পোশাক রফতানি প্রতিষ্ঠান রূপসী শিল্প গ্রুপ তিন বছরে বিদেশে পাচার ও সরকারের কোষাগার থেকে আত্মসাৎ করেছে প্রায় ৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে পাচার করেছে ৫৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। একই সঙ্গে জালিয়াতি করে সরকারের নগদ সহায়তার ২৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। রফতানি-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিলের অর্থ থেকে ১ শতাংশ হারে কর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরএভার-২১’ প্রতিষ্ঠানের কাছে পাচার করা হয় ওই পরিমাণ অর্থ। সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার কার্যক্রম তদন্ত করে গ্রুপটির এই অর্থ পাচার ও আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
টিমের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত থেকে আমদানি করা সুতায় কাপড় তৈরি করে পোশাক রফতানি করেছে ওই শিল্প গ্রুপ। অথচ জালিয়াতি করে দেশীয় মিল থেকে ওই সুতা কেনা হয়েছে দেখিয়ে সরকারের তহবিল থেকে নগদ সহায়তার ২৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

 
সূত্র জানায়, রূপসী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রূপসী নিটওয়্যার, রূপসী ফেব্রিক্স কমপ্লেক্স ও গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেনামি প্রতিষ্ঠান সালমান নিট কম্পোজিটের নামে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ওই পরিমাণ টাকা পাচার ও আত্মসাৎ করা হয়।
অর্থ পাচার ও আত্মসাতের ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য জানার জন্য বৃহস্পতিবার রূপসী গ্রুপের এমডি মো. সোহরাওয়ার্দীর নম্বরে ফোন করলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফোনে বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি বিদেশ সফরে আছেন।

 
সোনালী ব্যাংকের চার সদস্যের তদন্ত টিম সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখায় ওই জাল-জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত করেছে। তদন্ত টিমের সদস্যরা হলেন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মো. আনিসুজ্জামান, এস এম ওবায়দুর রহমান, এক্সিকিউটিভ অফিসার বিপ্লব ভূষণ বক্শী ও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আরিফ। সূত্র জানায়, ২০১০-১২ পর্যন্ত তিন বছরে রূপসী গ্রুপের কর্তাব্যক্তি ও ব্যাংক শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও আত্মসাৎ করা হয়। ওই গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে রফতানি এলসি খোলার ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে সোনালী ব্যাংক থেকে সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীকে অভিযোগটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

 
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রফতানি-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিল বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়ার পর ওই সব বিলের অর্থ থেকে ১ শতাংশ হারে কর্তন করে রূপসী গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরএভার-২১’ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৭১ লাখ ৯১ হাজার ৬১৫.৯৪ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ৫৭ কোটি ৫৩ লাখ ২৯ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা পাচার করেছে। যে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ পাচার করা হয়, ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। তদন্তকালে নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ক্রেতার সঙ্গে ‘ফরএভার-২১’-এর ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। বিদেশি ওই প্রতিষ্ঠানের ই-মেইল বার্তা যাচাই করেও অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ।

 
সোনালী ব্যাংকের তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার পোশাক রফতানিকারকদের উৎসাহিত করতে দেশীয় বস্ত্রকল থেকে সুতা ক্রয় করে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছে। সরকারের ওই আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য ভারত থেকে আমদানি করা সুতাকে জালিয়াতি করে দেশীয় উল্লেখ করেছিল রূপসী গ্রুপের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। নগদ অর্থ সহায়তা-সংক্রান্ত সার্কুলার উপেক্ষা করে সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা থেকে আত্মসাৎ করা হয় মোট ২৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এতে ব্যাংকের আর্থিক ঝুঁকি বেড়েছে এবং সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে।

 
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শাখার কাগজপত্রে দেখা গেছে, গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রূপসী নিটওয়্যার, রূপসী ফেব্রিক্স কমপ্লেক্স ও গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেনামি প্রতিষ্ঠান সালমান নিট কম্পোজিটের নামে অ্যাডভান্স টিটি শাখায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা জমা দেখানো হয়েছে। ওই সব টিটির নথিতে রফতানি চুক্তিপত্র, ঋণপত্র (এলসি), ইএক্সপি ও ইনভয়েস নম্বর পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখায় ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০০ দাবির বিপরীতে বিকল্প নগদ সহায়তার মোট ৭১ কোটি সাত লাখ ৮৭ হাজার ৪১৯ টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৭০টি দাবির বিপরীতে ২৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রূপসী গ্রুপের কর্ণধাররা।
জানা গেছে, অন্য আরেকটি ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা থেকেই রফতানির নামে ব্যাংকের ২৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুটি গার্মেন্ট মালিকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করছে দুদক। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার গার্মেন্ট দুটি নিট পোশাক রফতানির নামে ব্যাংকের ওই শাখা থেকে মোট ২৬ কোটি ৬৪ লাখ ৬১ হাজার ১৪৭ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর মধ্যে মেসার্স সিয়াম নিটওয়্যার ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে পোশাক রফতানির জন্য ২৫ কোটি পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯ টাকা ঋণ নিয়ে ২১ কোটি ৩৮ লাখ ছয় হাজার ৬৫৪ টাকা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করেছে।
২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সিয়াম নিটওয়্যার ৪৪টি ও তাহা নিট কনসার্ন ২৮টি ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *