৪ শীর্ষ কর্মকর্তাকে শ্রম আদালতে হাজিরের নির্দেশ

Slider বাংলার আদালত
6_340607
ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডের (ডব্লিউপিপিএফ) প্রায় ৭শ’ কোটি টাকা উদ্ধারে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বুধবার কোম্পানির শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (রেজি নং-বি ২১৬১) সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বাদী হয়ে ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে এ মামলা দায়ের করেন। শ্রম আইন অনুযায়ী কোম্পানির মুনাফার লভ্যাংশ না পেয়ে তিনি এ মামলা করেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। মামলার পর আদালতের চেয়ারম্যান তাবাসসুম ইসলাম গ্রামীণফোনের সিইওসহ পাঁচজনের কাছে লিখিত জবাব চেয়ে নোটিশ জারি করেছেন।

যাদের নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে তারা হলেন- গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব শেঠি, কোম্পানির অংশগ্রহণ তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান কাজী মোহাম্মদ শাহেদ, সদস্য মাইনুর রহমান ভুইয়া, মঈনুল কাদের ও আহমেদ মনজুরুদ্দোহা। আগামী ২ নভেম্বর তাদের ব্যক্তিগতভাবে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়ে জবাব এবং প্রয়োজনীয় কাগজ বা দলিল আদালতে দাখিল করতে হবে।

মামলার বাদী কামরুল হাসান বলেন, ‘২০১০ সাল থেকে তার পাওনা অংশের ২১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার দাবিতে মামলাটি করেছি। বারবার চেয়েও এ টাকা পাচ্ছি না, যে কারণে শেষ পর্যন্ত আদালতের দারস্থ হতে হল। আশা করি ন্যায়বিচার পাব।’

মামলা প্রসঙ্গে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হল- আদালতের কোনো আদেশ বা নোটিশ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা পায়নি। তাই এ বিষয়ে এখনি কেউ কিছু বলতে পারছি না।

২০০৬ সাল থেকে গ্রামীণফোনে কাজ করছেন কামরুল। শ্রম আইন অনুসারে ২০১০ সালে এই কোম্পনির ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন ফান্ড গঠন করা হয়। শ্রম আইন অনুযায়ী, ১০০ জনের বেশি কর্মী সংখ্যার কোনো কোম্পানির হিসাব বছরের শেষ দিনে পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি টাকা এবং স্থায়ী সম্পদ দুই কোটি টাকা হলে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল কিংবা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে বার্ষিক লভ্যাংশের ৫ শতাংশ জমা দিতে হয়। আইনে বলা আছে, প্রত্যেক বছর অংশগ্রহণ তহবিলে জমাকৃত মোট অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ সমান অনুপাতে সব সুবিধাভোগীর মধ্যে নগদে বণ্টন করতে হবে এবং এক-তৃতীয়াংশ ধারা (শ্রম আইনের) ২৪০ (১১)-এর বিধান মোতাবেক বিনিয়োগ করা হবে- যার মুনাফা সুবিধাভোগীদের মধ্যে সমান অনুপাতে বণ্টন হবে। কামরুল বলেন, ‘গত জুলাইয়ে ফান্ডের টাকা দেয়ার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়, কিন্তু তখন শ্রমিকদের টাকা না দিয়ে শুধু অফিসারদের টাকা দেয়া হয়েছিল। কোনো শ্রমিক এ ফান্ডের টাকা পায়নি।’ তার দাবি, গ্রামীণফোনের বিভিন্ন বিভাগের তিন হাজার কর্মচারী প্রায় ৭০০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানের কাছে পাবেন। গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ নিজেরাই শ্রমিক সেজে এ অর্থ আÍসাৎ করেছেন। তার মতে, এক তহবিলের অর্থ অন্য তহবিলে অবৈধভাবে স্থানান্তর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ। বিদ্যমান আইনে বিষয়টি দুদক দিয়ে তদন্ত করারও দাবি জানান তিনি।

তিনি বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী লাভজনক যে কোনো প্রতিষ্ঠান তার লভ্যাংশের অর্থ ৫ শতাংশ হারে ‘ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড’ (ডব্লিউপিপিএফ)-এ জমা হবে। এ অর্থ ডব্লিউপিপিএফ রিজার্ভ রাখতে হবে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গ্রামীণফোনের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ হিসেবে ৪ বছরে ৬৯৭ কোটি ৩৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯ টাকা রিজার্ভ থাকার কথা। কিন্তু গ্রামীণফোনের লভ্যাংশে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ তহবিলের এ অর্থ হাতিয়ে নেন গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা। ট্রাস্টির চার সদস্যের তত্ত্বাবধানে এ অর্থ প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তার মাঝে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। আর ভাগবাটোয়ারার নেতৃত্বে ছিলেন গ্রামীণফোনের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা ও বোর্ড অব মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক শরীফ আহমেদ (পদাধিকারবলে ট্রাস্টির সদস্য), একই বিভাগের সাবেক পরিচালক কাজী মোহাম্মদ শাহেদ আহমেদ (বর্তমানে টেলিনরের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইলিনরের ভারতীয় শাখার প্রধান মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক), গ্রামীণফোনের টেকনিক্যাল বিভাগের স্পেশালিস্ট ট্রাস্টির চেয়ারম্যান আহমেদ মঞ্জুর উদ্দৌলা এবং কর্মকর্তা মইনুল কাদের।

কামরুল হাসান বলেন, ২০১০ সালে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ আয়কর বিভাগে যে আর্থিক হিসাব বিবরণী দাখিল করে সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির ‘ডব্লিউপিপিএফ’ তহবিলে ১০৫ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার ১০২ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। ২০১১ সালে এ তহবিলে স্থানান্তর করা হয় ২৭২ কোটি ৯১ লাখ ৯১ হাজার ৭৮৭ টাকা। ২০১২ সালের ডব্লিউপিপিএফ’ তহবিলে ১৫৫ কোটি ২৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৪ টাকা স্থানান্তর হয়। ২০১৩ সালে দেখানো হয় ১৬৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭৪ হাজার ৩৯৬ টাকা। অথচ গ্রামীণফোনের ‘পিপলস কাউন্সিল’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মিয়া মোহাম্মদ মাসুদ ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের জানান, ২০১০ সালে ডব্লিউপিপিএফ’র বাবদ গ্রহণ করা হবে ১০৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে ১৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ দুই বছরে সাড়ে ৫ কোটি ৯৭ লাখ ২৭ হাজার ৮৭৬ টাকার হদিস পাওয়া যায়নি। বোর্ড অব ট্রাস্টি যে ৬৯১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৩ টাকা বুঝে পেয়েছে সেটিও ‘এফ’ ক্যাটাগরির ১৩ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীরা পাননি। ভাগাভাগি হয় গ্রামীণফোনের ‘এ’ থেকে ‘ই’ ক্যাটাগরির ৩৪০৭ কর্মকর্তার মধ্যে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা আন্দোলনে নামলে অর্থ আত্মসাৎকারী কর্মকর্তারা তাদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি শুরু করেন। অনেকের চাকরি পর্যন্ত হারাতে হয়। চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি বঞ্চিত কর্মচারীরা গ্রামীণফোন প্রধান কার্যালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট পালন করতে চাইলে র‌্যাব তাদের ওপর ব্যাপক লাঠিপেটা করে।

এ ঘটনায় অনেক শ্রমিক আহত হন। কামরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের অনেকেরই এখন ইনক্রিমেন্ট ও বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। আতংকে দিন কাটাতে হচ্ছে। ২ বছরের বেশি সময় ধরে ইউনিয়ন কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা হয়েছে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ দিয়ে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালেও আমাদের আবেদনের শুনানি হচ্ছে না।’

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন সৈয়দ তালাত কামাল যুগান্তরকে বলেন, ২০১০-১২ সালের তহবিল নিয়ে উত্তর দেয়ার এখতিয়ার শুধু বোর্ড অব ট্রাস্টির। প্রস্তাবিত গ্রামীণফোন এপ্লয়িজ ইউনিয়ন গঠনের বিষয়টি বর্তমানে শ্রম আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আছে। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *