নির্বাচনে না যেতে জিএম কাদেরকে তৃণমূলের বার্তা

Slider রাজনীতি

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।
বিএনপি ও জামায়াতসহ মাঠের রাজনৈতিক দলগুলোর বাধা উপেক্ষা এবং সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মহলের নানা দাবি ও আপত্তি উপেক্ষা করে গতকাল তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও জামায়াতসহ অধিকাংশ দল রাজপথে থাকলেও জাতীয় পার্টির অবস্থান এখনো অস্পষ্ট। দলটির কেন্দ্রীয়, জেলা উপজেলাসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচন না যাওয়ার পক্ষে গত মঙ্গলবার পার্টির চেয়ারম্যানকে বার্তা দিয়েছেন। রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় বিভিন্ন জেলার ৫৯ জন নেতা বক্তব্য দেন এদের মধ্যে ৫৭ জন নেতাই বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের অংশ না নেয়ার বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দেন বলে সভা সূত্রে জানা যায়।

জাপা সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য ঘোষণা দিয়েছিলেন জাপার তখনকার চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। কিন্তু তাকে মাইনাস করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেন। রওশন এরশাদ হন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা। প্রায় একই ফরমূলায় ‘১৪ সালের স্টাইলে’ এবারের নির্বাচনও অনুষ্ঠানের আশঙ্কা দেখছেন জাতীয় পার্টির শীর্ষ কয়েকজন নেতা। তারা এখন জিএম কাদেরের সাথে থাকলেও যেকোনো সময় রওশন এরশাদের সাথে মিলে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন বলে জিএম কাদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে। এটি নিয়ে জিএম কাদেরও বেশ চিন্তায় রয়েছেন। জাপায় এখন ‘১৪ সালের নির্বাচনের খেল’ শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়।

জাপা সূত্র বলছে, গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাপার নির্বাহী কমিটির সভায় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুুল হক চুন্নু বক্তব্য রাখলেও অন্য কোনো শীর্ষনেতা বক্তব্য রাখেননি। সভার শেষ পর্যায়ে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক উপস্থিত নেতাকর্মীদের কাছে জানতে চান, আওয়ামী লীগের সাথে না থাকলে আমরা কী করব? এ সময় উপস্থিত নেতারা সম্মিলিতভাবে উচ্চৈঃস্বরে বিএনপির সাথে আন্দোলন করতে বলেন। জনগণের সেন্টিমেন্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার কথা বলেন তারা।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্র থেকে জেলা উপজেলাসহ তৃণমূলের বেশির ভাগ নেতাকর্মীই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে। আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়ে গুটিকয়েক নেতা সুবিধা নিলেও বেশির ভাগই বঞ্চিত গত ১৫ বছরে। বিশেষ করে গত দুই মেয়াদে (২০১৪ ও ২০১৮) বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সঙ্গ দিয়ে সরকার গঠনে সহযোগিতা করলেও দলের চিহ্নিত গুটিকয়েক নেতা সুবিধা নিলেও দলেরই ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করে তৃণমূল। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও আন্তর্জাতিক চাপ ডিঙ্গিয়ে আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা। কিন্তু দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যানদের (৭ জন) প্রায় অধিকাংশই নির্বাচনী ট্রেনে উঠতে চান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এমনকি জিএম কাদের রাজি না হলে ২০১৪ সালের মতো রওশন এরশাদকে নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এসব নেতা। অন্যদিকে, নির্বাচনে অংশ নিতে আওয়ামী লীগ ও সরকারসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকেও চাপ বাড়ছে জিএম কাদেরের উপর। জিএম কাদের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, এমতাবস্থায় পার্টি প্রধান উভয় সঙ্কটে পড়েছেন। তবে, শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে যাওয়াই লাগতে পারে জিএম কাদেরকে।

সভায় রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতক। এদের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আমাদের এমপিরা যদি ডুয়েল রোল প্লে না করে- তাহলে আওয়ামী লীগ এককভাবে এদেশে কোনো নির্বাচন করতে পারবে না। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল আলম রুবেল বলেন, আওয়ামী লীগ তিলে তিলে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করেছে। ১৫ বছরে আমাদের কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয় নাই। আমাদের যারা এমপি ছিলেন তাদেরও ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়েছিল। রুবেল দলীয় এমপিদের উদ্দেশ্যে বলেন, দুইবার এমপি হয়েছেন, আর না হলে কি হয়? এবার জনগণের পক্ষে আসুন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি নুরুচ্ছফা সরকার বলেন, এ সরকারের সাথে থাকা ঠিক হবে না। এদের গণভিত্তি নেই। জনগণের মাঝে যাদের কোনো অবস্থান নেই, তাদের সাথে গেলে মানুষ আমাদের বেঈমান বলবে।

নেতাদের উদ্দেশে জিএম কাদের যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র চিঠি প্রসঙ্গে বলেন, অল্প কথায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এতে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা চাই। সেখানে নিঃশর্ত সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। ভিসা রেস্ট্রিকশন অ্যাপ্লাই করার কথা বলা হয়েছে। তার মানে হলো, সুুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয়, সরকার যদি সংলাপ না করে, তাহলে নির্বাচনে আমরা গেলে আমাদের ওপর স্যাংশন আসতে পারে। যদি আলাপ আলোচনা না করে, সরকারের ওপর ডেফিনেটলি বড় ধরনের স্যাংশনস আসতে পারে। তারা দেশের ওপর স্যাংশনস দেবে না, ব্যক্তিগতভাবে দেবে। সরকার চিঠিটা গুরুত্ব দিয়ে পড়লে সংলাপের ব্যবস্থা করতেও পারে। তিনি বলেন, আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। যেহেতু পরিস্থিতি এখনো অস্পষ্ট। কোথায় পা দিলে আমি পড়ে যাব অন্ধকারে, কোথায় পা দিলে শক্ত অবস্থানে যাব, এটা এখনো বোঝা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে, এদিন রাতেই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করে জিএম কাদের। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা থাকলেও জাপা চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মাশরুর মাওলা বলেন, এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল মাত্র। এর বাইরে কিছু নয়। তবে জাপার একটি সূত্র বলছে, এই বৈঠকে বাংলাদেশের বড় তিনটি দলকে চিঠি দিয়ে ‘পূর্বশর্ত ছাড়া’ সংলাপে বসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু যে চিঠি দিয়েছেন-এ প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়। জিএম কাদের রাষ্ট্রপতিকে সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

সামগ্রিক বিষয়ে গতকাল বুধবার জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, নির্বাচন কমিশনকে তাদের তফসিল ঘোষণা করতেই হবে। এটার বিকল্প নাই। তফসিল ঘোষণা করছে ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল সরকারের পক্ষ থেকে সবার সাথে (রাজনৈতিক দল) বসা হবে। পরিবেশ (নির্বাচনের) সৃষ্টির পর যদি কমিশন তফসিল ঘোষণা করত তাহলে ভালো হতো। তারপরও বলতে পারি, তফসিল ঘোষণা করলেও পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যদি সরকার উদ্যোগ নেয়, আলোচনায় বসে তাহলে কমিশনের তফসিলের তারিখ পরিবর্তনের ক্ষমতা আছে। এ রকম আগের নজির আছে।

ইসির তফসিল ঘোষণা নিয়ে আমাদের কোনো কথা নাই। আমাদের কথা একটাই, নির্বাচনের পরিবেশ চাই। জাতীয় পার্টি নির্বাচন করার জন্য দলীয়ভাবে প্রস্তুত আছি। প্রার্থী বাছাই, মেনোফেস্ট, ফরম ছাপানো-সব কাজই আমরা করে রেখেছি। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না যে, নির্বাচন করব কি করব না। কারণ, গত ৫ বছরে এই সরকারের আমলে স্থানীয় নির্বাচনসহ যেসব নির্বাচন হয়েছে অভিজ্ঞতা ভালো না। গতকাল (মঙ্গলবার) তৃণমূলের নেতারা বলেছেন, এই সরকারের আমলে যেসব নির্বাচন হয়েছে তা ভালো হয়নি। তারা যদিও চেয়ারম্যানকে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছে। চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা মেনে নেবেন।

মহাসচিব বলেন, আসলে দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুটি বড় দল। গত ৩০ বছর ধরে দেশ শাসন করছে। নির্বাচনটা কী প্রক্রিয়ায় হবে, একটা ঐকমত্যে আসতে পারেনি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। দেশ ও জাতির জন্য খুবই উদ্বেগজনক। দুই দলকেই নিজেদের দাবি থেকে সরে এসে সংলাপে বসার আহ্বান জান চুন্নু। আলোচনায় বসলেই সমাধানের রাস্তা বের হয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *