মাঠ কার্যালয়ের নিরাপত্তা চাইলেন ইসির কর্মকর্তারা

Slider সারাদেশ


আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মাঠ কার্যালয়গুলো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে তারা বলেন, ওই সময়ে ১৫০টির মতো কার্যালয়ে হামলা হয়। বগুড়ায় নির্বাচন কার্যালয়ে পেট্রোল বোমা মারা হয়। কোনও পক্ষ নির্বাচন বর্জন করলে এবারও ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এ বিষয়ে তারা মাঠ কার্যালয়গুলোর নিরাপত্তা জোরদার করার দাবি জানিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তা ও তাদের কার্যালয়ের নিরাপত্তায় আনসার সদস্য মোতায়েনের কথা বলেন। যদিও আনসার মোতায়েনের প্রস্তাব নাকচ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সুপারকে চিঠি দিতে আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে কর্মকর্তাদের জানিয়েছে। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সাপ্তাহিক বন্ধের দিন শনিবার (৭ অক্টোবর) নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ের সমস্যা ও প্রস্তুতির বিষয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠকে আগামী নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে অভিজ্ঞদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, ভোটের আগে মাঠ কার্যালয়গুলোর শূন্য পদে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, যেসব জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার গাড়ি নেই সেখানে গাড়ি দেওয়া, ব্যালট পেপার ছাড়া নির্বাচনের অন্যান্য সরঞ্জাম নির্দিষ্ট সময়ের আগে জেলা পর্যায়ে পাঠানোসহ বেশ কিছু প্রস্তাব করেন তারা। এ বৈঠকে পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান সিইসি। এর জবাবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকায় না থাকলে সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে পোলিং এজেন্টদের তেমন কিছুই করার থাকে না। বরং সব দল অংশ নিলে পোলিং এজেন্টরাই ভোটকেন্দ্রের পাহারাদার হন। বৈঠকে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওতাধীন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথমবার এ মতবিনিময়ের আয়োজন করে ইসি। এতে দেশের ১০টি অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও ৬৪ জেলার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠকে ২০ জন আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বক্তব্য দেন। অপরদিকে কমিশনের পক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ও বেগম রাশেদা সুলতানা বক্তব্য রাখেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে একজন সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ের নিরাপত্তার বিষয়টি তোলেন। তার বক্তব্যের রেশ ধরে মোট চারজন আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। যদিও একই বিষয়ে বার বার বক্তব্য না দিতে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম অনুরোধ করেন।

ইসির মাঠ কার্যালয়ের নিরাপত্তার বিষয়ে কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনে কয়েকটি দল অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনে মাঠ কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। জেলা প্রশাসক, ইউএনও ও পুলিশ সুপার কার্যালয়গুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল, থাকে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে না। এবারের নির্বাচন ঘিরে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

সিইসি জানান, নির্বাচন কর্মকর্তারা নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দিলে কমিশন সচিবালয়ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করবে। আরও জানা গেছে, নির্বাচনে ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনায় একজন কর্মকর্তা বলেন, ভোটকক্ষের গোপনবুথের ডিজাইনে পরিবর্তন আনা দরকার। তিনি গোপনকক্ষ ঘেরাওয়ের জন্য ইসির লোগো সম্বলিত কালো কাপড় কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহের প্রস্তাব দেন। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টেনে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, গোপনকক্ষে ফোল্ডিং করা যায় এমন পর্দা ব্যবহার করা যেতে পারে। নির্বাচনি সরঞ্জাম মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর বিষয়ে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ব্যালট পেপার ছাড়া বাকি সরঞ্জামাদি আগেভাগে পাঠালে সেগুলো বণ্টন করতে সুবিধা হয়। দুর্গম ও চরাঞ্চলের কেন্দ্রের যাতায়াতে দ্রুত যানবাহনের ব্যবস্থার দাবি জানান তারা। এছাড়া ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা যথা প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাবদ সম্মানী ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা এবং দুর্গম জেলার ভোটকেন্দ্র প্রস্তুতির খাতে ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেন।

আরও জানা গেছে, ঘুরেফিরে কর্মকর্তারা নিজেদের দাবি-দাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তারা বৈঠকে জানান, কয়েকটি জেলায় নির্বাচন কর্মকর্তাদের গাড়ি চলাচলের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার মোটরসাইকেল নেই। নির্বাচনের আগে এসব যানবাহন চান তারা। ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, ইসির কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে। এ নির্বাচনে তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিলে তারা আস্থার প্রতিফলন দেবেন। ইসির কর্মকর্তাদের পদন্নোতি দেওয়ার দাবি করে কয়েকজন বলেন, অনেক কর্মকর্তা ১৯ বছর চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি পাননি। বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হচ্ছে না। এছাড়া দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা পদ আপগ্রেডেশন ও অর্গানোগ্রাম দ্রুত অনুমোদনের দাবি জানান। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতো মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও নির্বাচনে অতিরিক্ত খাটুনি বাবদ পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রস্তাব দেন তারা।

কমিশন থেকে যে বার্তা দেওয়া হয়

বৈঠকের শুরুতেই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, সরকারের জনপ্রশাসন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় কীভাবে সুদৃঢ় এবং সহজ হবে সেটা বের করে নির্বাচনের যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনের ফলাফল উঠে আসবে, আমরা সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো। বৈঠকে তিনি জানান, আমার মনের বাসনা ও ইচ্ছা হচ্ছে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। ওই নির্বাচনে অধিক সংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করুক। বেগম রাশেদা সুলতানা বলেন, আমরা সুন্দর ও অবাধ নির্বাচন হোক তা চাই। নির্বাচন বিতর্কিত হোক তা চাই না। সভা শেষে ইসির মিডিয়া সেন্টারে বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। তিনি বলেন, এটা মূলত প্রাথমিক সভা। নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়েছে, কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মূলত ভোটার তালিকা, ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। তাদের সুনির্দিষ্ট সমস্যা আছে কিনা, একেক অঞ্চলে একেক সমস্যা থাকতে পারে- সেটা জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যেমন পার্বত্য অঞ্চলে কিছু কেন্দ্র আছে। এরকম সব জায়গায় কিছু কিছু নির্দিষ্ট সমস্যা আছে, তা অবহিত হয়েছে কমিশন। কোথাও কোনও ত্রুটি থাকলে ইসিতে জানানোর জন্য বলা হয়েছে। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলাসহ সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেন, মাঠ কর্মকর্তারা কোনও ঘাটতির কথা উল্লেখ করেননি। নির্বাচনি আচরণবিধি যাতে সবাই মেনে চলে, এজন্য তারা সকলের সহযোগিতা কামনা করেছে। এই বিষয়েই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা সংক্রান্ত কোনও আলোচনা এই বৈঠকে হয়নি জানিয়ে অশোক কুমার বলেন, তেমন কোনও চ্যালেঞ্জ বা সংকটের কথা তারা বলেনি। মাঠের পরিবেশ এখনও ভালো আছে। বৈঠকে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতার কথা বলেছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার সকলের সহযোগিতা নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈঠকে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সেগুলো প্রশাসনিক। কোনও রাজনৈতিক সমস্যার কথা তারা বলেননি।
Google News Logoবাংলা ট্রিবিউনের খবর পেতে গুগল নিউজে ফলো করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *