ঝুঁকিতে আমানতকারীরা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


অনিয়িমতান্ত্রিক ঋণ ও যথাসময়ে তা পরিশোধ না করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে যাওয়া ৯০ শতাংশ অর্থই কুঋণে পরিণত হয়েছে, যা আদায় অযোগ্য ঋণ হিসেবে ধরা হয়। এ কুঋণ বেড়ে যাওয়ায় এক দিকে ব্যাংকিং খাতের আয়ের বড় একটি অংশ আয় খাতে নেয়া যাচ্ছে না, অর্থাৎ অর্জিত সুদ স্থগিত করে রাখা হচ্ছে। অপর দিকে যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে ঋণ ঝুঁকি কমাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এতে ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিকভাবে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জুন শেষে শুধু আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ১২.৫ হাজার কোটি টাকা এবং বেসরকারি খাতের চার ব্যাংকের ১৩.৫ হাজার কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় মূলত আমানতকারীদের জমাকৃত অর্থের সুরক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু যেসব ব্যাংক সঞ্চিতির কোটা পূরণ করতে পারেনি সেসব ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ কোনো কারণে ব্যাংক সমস্যায় পড়লে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া কঠিন হবে। এ দিকে ব্যাংক কোম্পানি আইনেও আমানতকারীদের এ অবস্থায় সুরক্ষা দেয়ার কোনো উপায় রাখা হয়নি। কারণ কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হলে সেই ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে লিখিত কোনো আইন পর্যন্ত নেই। এর সুযোগ নিচ্ছে অনেক ব্যাংক। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতাও বলা যায়। আর আইন না থাকায় দেউলিয়া কোনো ব্যাংকের আমানকারীদের অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য আমানত রক্ষায় আমানতকারীদের সজাগ থাকতে হবে। তাদের কোন ব্যাংকে আমানত রাখতে হবে সেটা তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাজারে ব্যাংকের যেসব তথ্য পাওয়া যায় বাস্তবতার সাথে অনেক ব্যাংকেরই মিল নেই। যেমন, কিছু কিছু ব্যাংক কাগজে-কলমে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে, যেখানে তিন মাস আগেও যা ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিল করা, ব্যবসায়ীদের চাপে নানা ধরনের ছাড় দেয়ার পরেও খেলাপি ঋণ কমছে না। বরং তা বেড়ে যাচ্ছে। আর এ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের নগদ আদায় কমে যাচ্ছে। নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতা যেমন কমে যাচ্ছে তেমনি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

ব্যাংকার জানিয়েছেন, প্রভিশন হলো ব্যাংকের একটি অন্যতম সূচক এবং আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের একটি কার্যক্রম যেখানে লাভের কিছু অংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রাখা হয়। ঋণ-বিনিয়োগ প্রদানের ফলে যে অংশটুকু অনাদায়ী হয়ে যায় এবং আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিশ্চিত হওয়া যায় না, ফলে সম্ভাব্য ক্ষতির সৃষ্টি হয়। সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় যে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করে তা নির্ধারিত সময় শেষে সুদে-আসলে ফেরত দিতে হয়। ব্যাংক আমানত নিয়ে বেশি সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সুদে-আসলে আদায় করার পর তা আমানতকারীদের মুনাফাসহ ফেরত দেয়া হয়। ঋণ ও আমানতের সুদ হারের পার্থক্যই হলো মুনাফা। কোনো কারণে গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর এ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে একটি অংশ জমা রাখতে হয়, যা ব্যাংকিং ভাষায় প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি বলা হয়।

সাধারণত খেলাপি ঋণ ভেদে ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। উচ্চ মানের খেলাপি ঋণ বা কুঋণ হলে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। সন্দেহজনক বা মধ্য মানের খেলাপি হলে ৫০ শতাংশ এবং নিম্ন মানের খেলাপি হলে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আবার নিয়মিত ঋণের বিপরীতেও প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে এসএমই ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সংরক্ষণ করতে হয়। যার ফলে ব্যাংক সব ধরণের ঝুঁকিমুক্ত থাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিদেশী ব্যবসায়ীরা সাধারণত ব্যাংকের মূলধনের ভিত্তি ও খেলাপ ঋণ পর্যবেক্ষণ করে। শ্রেণিকৃত ঋণের সাথে প্রভিশন ঘাটতির বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। যখন কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকে তখন সেই ব্যাংক কোনো নতুন শাখা খুলতে পারে না; ক্যামেল রেটিং খারাপ হয়; ব্যাংকের তহবিল ব্যয় (কস্ট অব ফান্ড) বেড়ে যায়; পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ার মূল্য কমে যায়; বৈদেশিক বাণিজ্য করার জন্য শাখা খোলার অনুমোদন পায় না; ব্যাংকের রিটেন আর্নিং ও শেয়ারপ্রতি আয় কমে যায় এবং মূলধন ঘাটতিতে টান পড়ে। আর মূলধন ঘাটতিতে টান পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী ওই ব্যাংক বছর শেষে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। প্রভিশন ঘাটতি সমন্বয় করতে না পারলে বছর শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে, সেই সাথে কমে যাবে ব্যাংকের মুনাফা।

অর্থ সঙ্কটের কারণে অনেক ব্যাংকই প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযাযায়ী চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে আটটি ব্যাংক। এর মধ্যে চারটি সরকারি ও চারটিচ বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রভিশন ঘাটতি কমাতে না পারলে সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এজন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *