খালেদা জিয়াকে বাঁচান

Slider বাধ ভাঙ্গা মত

সৈয়দ আবদাল আহমদ:দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন তিনি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকরা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বলেছেন, ‘আপনাদের কিছু করার থাকলে করেন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। অবিলম্বে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারলে তাকে বাঁচানো দুষ্কর হয়ে পড়বে।’

দুঃখজনক হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতেও সরকার অনড়। আইনমন্ত্রী বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করতে হবে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিদেশে চিকিৎসার আবেদন জানিয়ে অনেক আগেই দরখাস্ত করা হয়েছে। প্রয়োজনে আবারো তারা আবেদন করবেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে আদালত সিদ্ধান্ত দিতে হবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আগের সুরেই বলেছেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়াকে বাসায় থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোববার এক অমানবিক বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি নাকি খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি করছে।

বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ চায় খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা। তাকে বাঁচানোর জন্য সর্বমহল থেকে দাবি করা হচ্ছে। উন্নত চিকিৎসা পাওয়া খালেদা জিয়ার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। কিন্তু প্রতিহিংসার কারণে তাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সরকার পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, তিনি কীসের সাজাপ্রাপ্ত আসামি? আইনজীবীরা সমাবেশ ও পদযাত্রা করে বলেছেন, রাজনৈতিক মামলায় ফরমায়েশি রায়ে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে রাতের ভোট সম্পন্ন করার জন্য তাকে নির্বাচনে অযোগ্য করা হয়েছে। ফরমায়েশি রায় দেশবাসী মানে না। খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে প্রতিদিনই সভা-সমাবেশ ও বিবৃতি আসছে। এসব সমাবেশ-বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে যে, খালেদা জিয়ার কিছু হলে বাংলাদেশ জ্বলে উঠবে। তার চিকিৎসার অবহেলা জনগণ বরদাশত করবে না। সাজাপ্রাপ্ত আসামির চিকিৎসার ব্যাপারেও দৃষ্টান্ত রয়েছে। এক-এগারোর জরুরি সরকারের সময় সাজাপ্রাপ্ত আসামি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আ স ম রব কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে জার্মানিতে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়।

তাই খালেদা জিয়াকে বাঁচানোর স্বার্থেই তাকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হোক। দলমত নির্বিশেষে সবাই আসুন, খালেদা জিয়াকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই, প্রয়োজনে তাকে স্থায়ী জামিন দিয়ে মুক্তি দেয়া হোক যাতে তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন ও মানবিক সংস্থা এগিয়ে এসে খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়ান।

খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৮ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন। বর্তমানে দেড় মাস ধরে তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ৯ আগস্ট তাকে তৃতীয়বারের মতো হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গৃহবন্দী থাকা অবস্থায়। এর মধ্যে দুই দফায় তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নিতে হয়েছে। খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ায় তার অবস্থার দিন দিনই অবনতি হচ্ছে বলে মেডিক্যাল বোর্ড জানিয়েছে।

দেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর জনগণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাধারণ গৃহবধূর জীবন থেকে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনি গণতন্ত্র মুক্তির দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন। জনগণ তাকে ‘দেশনেত্রী’ এবং ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও এক-এগারোর মঈন-মাসুদ চক্রের সেনাসমর্থিত সরকারের বিরাজনীতিকরণ চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তার দৃঢ়তার ফলেই অবরুদ্ধ গণতন্ত্র মুক্তি পায়। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধেও তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে চালানো হয়েছে জেল-জুলুম নির্যাতন।

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতীক এবং তিনবারের নির্বাচিত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি বড় ধরনের অবিচার ও জুলুম হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইতোপূর্বে বলপূর্বক খালেদা জিয়াকে তার স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে। গণতন্ত্রের সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি এ সরকারের হাতে বারবার নিগৃহীত হয়েছেন। গুলশানের বাসা ও অফিসে দফায় দফায় তাকে অবরুদ্ধ করে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। মিথ্যা ও প্রতারণামূলক মামলায় অন্যায় দণ্ডের মাধ্যমে তাকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো জেলখানার স্যাঁতস্যাঁতে কক্ষে দিনের পর দিন বন্দী করে রেখে তিলে তিলে তাকে প্রাণনাশের পথে ঠেলে দেয়া হয়। কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও উন্নত চিকিৎসার সুযোগ তিনি পাননি। পরিবারের পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার সুযোগ চাইলেও সে সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শেষ জীবনে এসে ৭৮ বছরের এই রাজনীতিবিদ অসহায় অবস্থায় এক কঠিন সময় পার করছেন। মানবাধিকার বলে তার জীবনে আজ কিছু নেই।

রাজনীতিতে ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে খালেদা জিয়ার। এ নির্বাচনের দু’দুবার বিএনপিকে বিজয়ী করে তিনি দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। দেশে প্রতিষ্ঠা করেন সংসদীয় গণতন্ত্র। দেশের উন্নয়নের অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। যমুনা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তার হাতে। সমাজ বিকাশ বিশেষত শিক্ষা তথা নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তার সাফল্য অনন্য। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আগে এক-এগারোর জরুরি সরকারও তাকে এক বছরের বেশি সময় বিনাবিচারে জেলে বন্দী করে রেখেছিল। জরুরি সরকারের অবসান ও জরুরি আইন তুলে নেয়ার ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু আজ তিনি যেভাবে রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার হয়েছেন তার কোনো নজির নেই।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে খালেদা জিয়ার অপরিসীম ত্যাগ রয়েছে। স্বামী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ সময় একাত্তরের বন্দী শিবিরে দুই শিশু পুত্রকে নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকার বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে।

গণতন্ত্রের মাতা হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত খালেদা জিয়া আজ যখন দুশ্চিন্তাহীন এক নতুন জীবন যাপন করার কথা, তখন তিনি অমানবিক নির্যাতনে দিশেহারা। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তাকে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন মালয়েশিয়ায়। গুলশান অফিসে অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকে ছেলের লাশ দেখতে হয়েছে তাকে। বড় ছেলে, ছেলের বউ, নাতনীরাও কাছে থাকার সুযোগ নেই। নির্বাসিত জীবনে থাকতে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যেও তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা চালাচ্ছে অপপ্রচার ও কুৎসা। বৃহত্তর অর্থে এখনো তিনি বন্দী। বিশেষ বিবেচনায় সাজা স্থগিত রেখে কারাগার থেকে গুলশানের বাসায় থাকার ব্যবস্থা হলেও স্বাভাবিক চলাফেলা নিষিদ্ধ। স্বাধীনভাবে তিনি কোথাও যাওয়া কিংবা তার সাথে কেউ দেখা করার সুযোগ থাকে না। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট আবার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। তার অবস্থা শোচনীয়। তাকে দেশের স্বার্থেই বাঁচাতে হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।
[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *