আলু পচে যাবে তবুও বেশি দাম ছাড়া রংপুরের আরমান কোল্ডস্টোরেজ থেকে বের হবে না। এমন একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে ওই হিমাগার কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হোতা রাসেল। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংক থেকে ভিন্ন কাজের জন্য লোন নিয়ে তা দাদন হিসেবে স্থানীয় আলু চাষিদের কাছে লগ্নি করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা করছে হিমাগারটি। উত্তরাঞ্চলে এই হিমাগার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সে কারণে এই অঞ্চলের প্রায় ২০০ হিমাগারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৭ থেকে ৩৯ টাকা দরে। অথচ বিক্রি করার কথা ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি। আলুর বাজারের নৈরাজ্যে কেউ কিছুই করতে পারছে না এখানে।
গতকাল বুধবার হিমাগারটিতে আলু সিন্ডিকেটের এই তথ্য উঠে এসেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের আড়াই ঘণ্টার অভিযানে। সকাল ৯টায় রংপুর মহানগরীর উত্তম এলাকার আরমান কোল্ডস্টোরেজে ঝটিকা অভিযান চালান ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। অভিযানে গিয়ে হিমাগারটির জি এম রেজাউল ইসলাম ও রাসেল নামের এক ব্যবসায়ীকে আসতে বলেন হিমাগারটিতে। কিন্তু তারা আসতে ঢিলেমি করায় পুলিশ পাঠিয়ে আনা হয় তাদের। কাগজপত্র যাছাই-বাছাই এবং জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে অবাক করা সব তথ্য। এতে তাজ্জব বনে যান খোদ ভোক্তা ডিজি। কারণ ২ লাখ ১০ হাজার বস্তা আলু মজুদের তথ্য থাকলেও মজুদ আছে অর্ধেকেরও বেশি। পচে গেলেও তারা বেশি দাম ছাড়া আলু ছাড়ছিলেন না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে ভোক্তার ডিজি হিমাগারের রেজাউল ও রাসেলকে জেরার মুখে ফেলেন। তারা কোনো সদুত্তর না দেয়ায় তাদের মেট্রোপলিটন হাজিরহাট থানায় সোপর্দ করেন তিনি।
অভিযানে ভোক্তার মহাপরিচালকের কাছে স্পষ্ট হয়, স্থানীয় আলু সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক রাসেল নামের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে আরমান হিমাগার কর্তৃপক্ষ ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা আলুতে দাদন হিসেবে লগ্নি করেছেন। অথচ ওই টাকা পূবালী ব্যাংক থেকে অন্য ব্যবসার জন্য নিয়ে প্রতারণা করে আলুতে লগ্নিকরে চাষিদের জিম্মি করছে হিমাগারটি।
ভোক্তা ডিজি জানান, আরমান হিমাগারের জি এম রেজাউল প্রথমে শুধু আলুর বস্তার টাকা নেয়ার কথা বললেও জেরাতে স্বীকার করেছেন ভয়াবহ তথ্য। ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তা রাসেলের মাধ্যমে আলু চাষিদের কাছে লগ্নি করেছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে আলু রাখতে হলে রাসেলের মাধ্যম আসতে হবে। এরকম একটি চেইনও করেছে তারা। সে কারণে রাসেল আড়াই হাজার বস্তা আলু উৎপাদন করলেও তার মাধ্যমে আরো সাড়ে ১২ হাজার বস্তা ওই হিমাগারে রাখা হয়েছে, যা কৃষকরা রাসেলের মাধ্যমেই রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের দুইজনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে পূবালী ব্যাংকের যে শাখা থেকে আরমান কোল্ড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষ ঋণ নিয়ে আলুতে লগ্নি করেছে সেটা খতিয়ে দেখার জন্য। কারণ তারা অন্য ব্যবসার জন্য লোন নিয়েছিল। এটা ব্যাংকের সাথে প্রতারণা। পরে তিনি হিমাগারটি থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির জন্য ডিসি ও কৃষি বিভাগকে দায়িত্ব দেন। একই দরে সব হিমাগার থেকে আলু বিক্রি নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনাও দেন তিনি।
ভোক্তা মহাপরিচালক বলেন, আরমান কোল্ড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষ এবং রাসেল নামের ওই ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে এই অঞ্চলে আলু সিন্ডিকেট করা হচ্ছে। এটা আমরা ভেঙে দিলাম। আরমান হিমাগারে এখন যে আলু মজুদ আছে তাদের তালিকা আমরা নিয়েছি। কর্তৃপক্ষ, ডিসি ও কৃষি বিভাগের লোকজনের উপস্থিতিতে প্রতিদিন এই হিমাগারটি থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করা হবে। ফড়িয়ারা এখান থেকে এই দামে বিক্রি করে রশিদ নিয়ে যাবে। সিরিয়ালে যারা আগে থাকবে তাদের আগে বিক্রি করে টাকা তাদের দিয়ে দিবেন। তিনি আরো বলেন, রংপুরসহ সারা দেশের প্রত্যেকটি হিমাগারের সামনে ২৭ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ওই দামে আলু বিক্রি নিশ্চিত করবে জেলা প্রশাসন এবং কৃষি বিভাগ। এর যারা ব্যত্যয় করবেন তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে।
পরে তিনি জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আলু ব্যবসায়ী ও কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের সাথে মতবিনিয়ম করেন। সেখানেও সঠিক তথ্য দিতে না পারায় এবং সিন্ডিকেট করায় চার ব্যবসায়ীকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন ভোক্তার ডিজি।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, রংপুর বিভাগের আট জেলার ১০৬টি হিমাগারে এখন প্রায় ৫ লাখ টন আলু মজুদ আছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগ বীজ আলু।