কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবায় বৈশ্বিক সহায়তা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

Slider জাতীয়


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কমিউনিটি ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের চাবিকাঠি। সকলের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর এ প্রচেষ্টাকে সহায়তার জন্য উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা বহুপাক্ষিক অর্থায়ন সংস্থাগুলোসহ আমাদের উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি উন্নয়নশীল বিশ্বে কমিউনিটি-ক্লিনিক স্বাস্থ্য সেবায় তাদের সহায়তার হাত প্রসারিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে ইউএনজিএ’র ৭৮তম অধিবেশনের সাইডলাইনে ‘শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ অফ কমিউনিটি ক্লিনিক : ইনোভেটিভ এপ্রোচ এচিভিং ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ ইনক্লুসিভ অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি’ শীর্ষক উচ্চ-স্তরের সাইড-ইভেন্টের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে তিনি এ আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন ও সার্বজনীন স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমাদের সম্মিলিত কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য এই বছর শপথ নেয়ার সময় আমরা আপনাদের উপস্থিতিতে উৎসাহিত বোধ করছি।’

শেখ হাসিনা আরো বলেন, গ্লোবাল সাউথের উদীয়মান কণ্ঠস্বর হিসেবে হিসেবে বাংলাদেশ অর্থপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের সম্ভাব্য উপায় হিসেবে ইস্যুটিতে চ্যাম্পিয়ন হবে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে, বাংলাদেশ আগ্রহীদের সাথে উপলব্ধি এবং দক্ষতা বিনিময় করতে প্রস্তুত আছে। সকল সুখের মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য। আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে চারদিকে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে চাই।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি মন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞদের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ, যারা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং এই মুহূর্তে তাদের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আশা করি যে, এই সাইড ইভেন্ট স্বাস্থ্য এবং আমাদের সকল জনগণ ও কমিউনিটির কল্যাণে আমাদের অভিন্ন অঙ্গীকারের আরেকটি নিদর্শন হয়ে থাকবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, তারা বুঝতে পেরেছেন যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পুনরায় চালু করা ও এগুলোর টেকসইয়ত্ব শুধুমাত্র এগুলোর মালিক ও রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী স্থানীয় জনগণের ওপর নির্ভর করে।9 প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, কেন ৯০ শতাংশ সেবাপ্রার্থী কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতি তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তা এই চিত্রটিই বলে দেয়।

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে তাদের পার্লামেন্ট কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্ট অ্যাক্ট পাশ করেছে। যাতে এর কার্যক্রম ও ফান্ডিং পদ্ধতি আরো সহজতর করা যায়। স্বাস্থ্যসেবা তৃণমূলে পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি অগ্রাধিকারের কথা ভাবেন। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় রোধ করতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করার জন্য পাঁচটি অগ্রাধিকার অন্তর্ভুক্ত করা, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে বিশেষত এনসিডিগুলোর জন্য উন্নত ডিজিটাল স্বাস্থ্য ও ডায়াগনস্টিক পরিষেবা প্রদান করতে সক্ষম করে তোলা এবং ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মতো ক্রমবর্ধমান জলবায়ু-জনিত স্বাস্থ্য সঙ্কট মোকাবেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর সক্ষমতা আরো উন্নত করা। অবশিষ্ট দুটি হলো মানসিক স্বাস্থ্য এবং স্নায়ুবিক ব্যাধির জন্য স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা সেবা উন্নত করা-যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে সেবা প্রদান করা এবং একটি শক্তিশালী ডেটা-চালিত স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রমের জন্য প্রাথমিক বিল্ডিং ব্লক হিসাবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ব্যবহার করা যায়।

শেখ হাসিনা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক একটি ধারণা যা বাংলাদেশে সময়ের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘এটি এখন আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ এই মডেলটিকে বাকি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি সর্বোত্তম অনুশীলন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।’

তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘ এটিকে ‘শেখ হাসিনা উদ্যোগ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় তিনি বিন্মচিত্তে কৃতজ্ঞতা বোধ করছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে তিনি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ সুবিধার উন্নয়নে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ছিল তাদের চালু করা উদ্ভাবনী ধারণাগুলোর মধ্যে একটি।

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা আমাদের জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।’

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই, বঙ্গবন্ধু সমগ্র জনগণের জন্য ‘চিকিৎসা সহায়তার ন্যূনতম সুযোগ’ দেয়ার জন্য গ্রামীণ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো তার স্বপ্ন এবং প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন।’

তিনি বলেন, এখন প্রায় ১৪ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, যা স্বাস্থ্য, পরিবার-পরিকল্পনা এবং পুষ্টি-সম্পর্কিত পরিষেবাগুলোর জন্য ওয়ান-স্টপ সেন্টার হিসাবে কাজ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল, এগুলো এখন সারা দেশে কাজ করছে।

তিনি বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো নবজাতক, শিশু এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’

তিনি উল্লেখ করেন, প্রায় ৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক জন্মদানের জন্য দক্ষতাপূর্ণ সেবার সুবিধা প্রদান করছে।

তিনি বলেন, গড়ে প্রতি মাসে ৯ দশমিক ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন লোক ক্লিনিকে সেবা নিতে আসে এবং সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সর্বজনীন টিকাদানের স্থানীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং তারা কোভিড-১৯ টিকার কভারেজ সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

তিনি বলেন, অসংক্রামক রোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য এবং স্নায়বিক ব্যাধিও পরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবং যেখানে সম্ভব মানসিক স্বাস্থের সহায়তা প্রসারিত করতে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছি। এজন্য কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কফোর্সের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা আপডেট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, তার সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ২৭টি প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং তিনটি পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী বিনামূল্যে প্রদান করছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক এবং অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ এজেন্ট দিয়ে প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো জরুরি ও জটিল ক্ষেত্রে উচ্চতর চিকিৎসা সুবিধার জন্য রেফারেল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।

তিনি বলেন, ‘সেবা প্রদানকারীরা স্বাস্থ্য ডেটা রেকর্ড করার জন্য ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে সজ্জিত। তারা স্বাস্থ্য এবং বিকলতা-সম্পর্কিত বিষয়গুলোর জন্য সামাজিক এবং আচরণগত পরিবর্তনের বিষয়গুলোতেও তারা সম্পৃক্ত।’

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর প্রতিটি ৬ হাজার জন লোককে সেবার আওতায় আনবে বলে আশা করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্লিনিকগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের একটি অনন্য মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, স্থানীয় লোকেরা এর জন্য জমি সরবরাহ করে এবং সরকার পরিচালনার খরচ বহন করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীদের বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে নেয়া এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা এগুলো পরিচালিত হয়।

তিনি বলেন, ২০০১ সালে, বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পর, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো প্রায় সাত বছর ধরে অবহেলিত ও পরিত্যক্ত অবস্থায় রাখা হয়েছিল।

অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ)-এর বিষয়ভিত্তিক রাষ্ট্রদূত সায়মা ওয়াজেদ।

অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে, সিন্ট মার্টেনের প্রধানমন্ত্রী সিলভেরিয়া এলফ্রিডা জ্যাকবস জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া এবং সর্বজনীন স্বাস্থ সেবা কভারেজ অর্জনকারী বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক মডেলের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

মালদ্বীপের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী সাফিয়া মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, এত শক্তিশালী নারী নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে পেরে তিনি অভিভূত।

তিনি সকলের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার উপায়গুলো সহজ করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্যোগেরও প্রশংসা করেন।

বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক উপস্থিত ছিলেন। জাতিসঙ্ঘের নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি মুহাম্মদ আবদুল মুহিত অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের ভূমিকা নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিও দেখানো হয়।

সূত্র : বাসস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *