দম্ভ বা অহঙ্কার ও তার পরিণতি

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


মাওলানা এম এ হালিম গজনবী এফসিএ: উপরোক্ত শিরোনামে দ্বিতীয়াংশে ফেরাউনের দম্ভ বা অহঙ্কার ও তার পরিণতি সম্পর্কে আংশিক আলোচনা করেছি আল্লাহর বাণী অবলম্বনে। বর্তমান অংশে ইনশাআল্লাহ আলোচনা করব ফেরাউনের দম্ভ বা অহঙ্কার ও পরিণতি সম্পর্কে। প্রথমত কুরআনের ১৫ টি আয়াতের শুধু অর্থ উল্লেখ করে এবং তৎপর আলোচ্য আয়াতসমূহে উল্লিখিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করে।
মূসা আ: ও দাম্ভিক ফেরাউন সম্পর্কে আল্লাহর ১৫ বাণী তথা আয়াতসমূহের শুধু অর্থ নিম্নোক্ত-
মূসা আ:-এর ওপর তাঁর জাতির মধ্য হতে গুটিকয়েক লোক ব্যতীত অধিকাংশ লোকই ঈমান আনেনি ফেরাউন ও তার প্রধানদের নির্যাতনের ভয়ে। বাস্তবিকই ফেরাউন দুনিয়াতে খুবই উদ্ধত বা উগ্র ছিল, আর সে ছিল অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা ইউনূস-৮৩)
মূসা আ: বলেছিল, ‘হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি বিশ^াস স্থাপন করে থাকো তাহলে তোমরা তাঁরই ওপর ভরসা করো যদি তোমরা (সত্যিকার) আত্মসমর্পণকারী হও’। (সূরা ইউনূস-৮৪) মূসা আ: তাঁর অনুসারীদেরকে সৎসাহসী করা বা উৎসাহিত রাখার জন্য আলোচ্য বাণীটি শুনালেন।

তখন তারা (মূসা আ:-এর অনুসারীরা) বলল, আমরা আল্লাহর ওপরই ভরসা করি, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জালিম জাতির অত্যাচারের পাত্র করো না। আর তোমার (আল্লাহর) অনুগ্রহে আমাদেরকে কাফির সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করো’। (সূরা ইউনূস : ৮৫-৮৬)

আমি (আল্লাহ) মূসা আ: এবং তার ভাইয়ের প্রতি ওহি করলাম যে, ‘মিসরে তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য ঘর তৈরি করো আর তোমাদের ঘরগুলোকে ইবাদত গৃহ করো আর নামাজ প্রতিষ্ঠা করো এবং মুমিনদেরকে সুসংবাদ দাও’। (সূরা ইউনূস-৮৭) আল্লাহর এ ব্যবস্থা তাদের নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছে।
মূসা আ: বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি ফেরাউন আর তার প্রধানদেরকে এ পার্থিব জগতে চাকচিক্য আর ধনসম্পদ দান করেছ আর এর দ্বারা হে আমাদের রব! তারা মানুষকে তোমার পথ থেকে বিচ্যুত করছে, হে আমার প্রতিপালক! তাদের সম্পদ ধ্বংস করে দাও, আর তাদের হৃদয়কে কঠিন করে দাও, যাতে তারা ভয়াবহ আজাব দেখার পূর্ব পর্যন্ত ঈমান আনতে সক্ষম না হয় (যেহেতু তারা বারবার আল্লাহর নিদর্শন দেখেও সত্য দ্বীনের শত্রুতায় অটল হয়ে আছে)। (সূরা ইউনূস-৮৮)

আল্লাহ তায়ালা জবাব দিলেন, ‘তোমাদের দু’জনের (মূসা আ: এবং হারুন আ:-এর উপরোক্ত) দোয়া কবুল করা হলো, কাজেই তোমরা মজবুত হয়ে থাকো, আর তোমরা কখনো তাদের পথ অনুসরণ করো না যারা কিছুই জানে না (ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কে)।’ (সূরা : ইউনূস : ৮৯)

আমি মূসাকে ওহি করলাম যে, আমার বান্দাহদেরকে নিয়ে রাতের বেলা যাত্রা করো আর তাদের জন্য সমুদ্রের ভিতর একটা শুকনো পথ বানিয়ে নাও। আর পেছন থেকে (ফেরাউন) ধরে ফেলবে এ ভয় করো না, আর (অন্য কোনো) আশঙ্কাও করো না। অতঃপর ফেরাউন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাদের পিছু নিলো, অতঃপর সমুদ্র তাদের ওপর চড়াও হলো আর তাদেরকে ডুবিয়ে দিলো। (সূরা ত্ব-হা : ৭৭-৭৮)
আমি (আল্লাহ) বনি ইসরাইলকে সমুদ্র (লোহিত সাগর) পার করিয়ে নিলাম আর ফেরাউন ও তার সৈন্যসামন্ত ঔদ্ধত্য ও সীমালঙ্ঘন করে তাদের পেছনে ছুটল, অতঃপর যখন সে ডুবতে শুরু করল তখন সে (ফেরাউন) বলল, ‘আমি ঈমান আনছি যে, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই যার প্রতি বনি ইসরাইল ঈমান এনেছে, আর আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। (সূরা ইউনূস-৯০) অর্থাৎ ফেরাউন ঈমান আনল বটে, কিন্তু তা বৃথা।

‘(ধিকৃত স্বরে আল্লাহ ফেরাউনকে বললেন) এখন ঈমান আনছ? অথচ পূর্ব (মুহূর্ত) পর্যন্ত তুমি নাফরমানি করছিলে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে (মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া মুহূর্তে আনা ঈমান কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়)। আজ আমি তোমার দেহকে রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারো। অধিকাংশ মানুষই আমার নিদর্শনাবলী সম্পর্কে নিশ্চিতই উদাসীন’। (সূরা ইউনূস : ৯১-৯২) আমাদের জানা দাম্ভিক ফেরাউনের লাশ মিসরের জাদুঘরে আল্লাহর তরফ হতে অদ্যাবধি সংরক্ষিত আছে বিশ্ববাসীর জন্য নিদর্শন হিসেবে।
ফেরাউন তার জাতিকে বিপথগামী করেছিল এবং তাদেরকে সঠিক পথ দেখায়নি। (সূরা ত্ব-হা-৭৯)
কাজেই আমি তাকে (ফেরাউন) ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম, অতঃপর তাদের সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। এখন দেখো, জালিমদের পরিণতি কী হয়েছিল’। (সূরা আল কাসাস-৪০)

লক্ষণীয়, দাম্ভিক বা অহঙ্কারী ফেরাউনের করুণ পরিণতি সব সৈন্যসহ লোহিত সাগরের পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করার মাধ্যমে এবং তার সংরক্ষিত মৃতদেহটা বিশ্ববাসীর জন্য নিদর্শন করলেন আল্লাহ তায়ালা আমাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য। তা ছাড়া ফেরাউন হবে জাহান্নমবাসী চিরকালের জন্য।
যে কেউ তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী অবস্থায় উপস্থিত হবে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম, সেখানে সে না মরবে, আর না বাঁচবে। (সূরা ত্ব-হা-৭৪)

মূসা আ: ও ফেরাউনের জাদুকরদের মধ্যে উপরোক্ত আয়াতসমূহে উল্লিখিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ :
ফেরাউনের জাদুকরদের প্রস্তাবের উত্তরে মূসা আ: তাদেরকে নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন তখন তারা তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো মাঠে ফেলতেই তা সর্পাকার ধারণ করে ছোটাছুটি শুরু করল যা দেখে মূসা আ: ভীত হয়েছিলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে অভয় দিয়ে আদেশ করলেন তার ডান হাতে যা আছে (লাঠি) তা জমিনে নিক্ষেপ করতে মূসা আ: আল্লাহর আদেশ পালন করলেন। তার হাতের লাঠি জমিনে নিক্ষেপ করতেই তা বিশাল সাপে পরিণত হলো এবং ফেরাউনের জাদুকরদের নিক্ষেপ করা বস্তু যা সাপে পরিণত হয়েছিল তা সবকিছু গিলে ফেলল। এ পরিস্থিতি দেখে ফেরাউনের জাদুকররা মূসা আ: আল্লাহর প্রেরিত রাসূল এ সত্য উপলব্ধি করতে পারল। ফলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিজদারত হয়ে পড়ল এবং মনেপ্রাণে দৃঢ় বিশ^াস করে সমস্বরে উচ্চারণ করল ‘আমরা হারুন ও মূসা আ:-এর প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম।’

এ অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় ঘটনা পরিদর্শন করে দাম্ভিক ফেরাউন ক্রোধান্বিত হয়ে তাদের শুনাল ‘আমার অনুমতি ব্যতীত তোমরা মূসার প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলে! ফলে তোমাদেরকে আমার তরফ থেকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। দাম্ভিক ফেরাউনের যে কথা সে কাজ, জাদুকরদের বিপরীতে অবস্থিত হাত পা কেটে দিলো (অর্থাৎ ডান হাত বাম পা অথবা বাম হাত ডান পা) এবং খেজুর গাছের কাণ্ডে দাঁড় করিয়ে গুলিবিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত তাদেরকে জ্ঞাত করল কিন্তু সদ্য ঈমান আনা জাদুকররা তাদের সিদ্ধান্তে দৃঢ় অবিচল ছিল এবং দাম্ভিক ফেরাউনকে জ্ঞাত করল ‘আমাদের নিকট যেসব স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তার ওপর আমরা তোমাকে কিছুতেই প্রাধান্য দেবো না সুতরাং তুমি যা ফয়সালা করতে চাও, তাই করো। তুমি তো কেবল এ দুনিয়ার জীবনের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারো।’ দাম্ভিক ফেরাউন তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করল। পরিশেষে মূসা আ:-এর নিকট দাম্ভিক ফেরাউন চূড়ান্ত পরাজিত হলো।
মূসা আ: ও তাঁর অনুসারীরা লোহিত সাগরের তীরে যখন ফেরাউনের বিশাল সৈন্যবাহিনী দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়ল তখন তারা নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলো হয় ফেরাউনের সৈন্য দ্বারা নিহত হয়ে অথবা লোহিত সাগরে ডুবে কিন্তু আল্লাহর রহমতে তারা বেঁচে গেল এবং প্রমাণিত হলো ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’।

আল্লাহর নির্দেশে মূসা আ: তার লাঠি দ্বারা লোহিত সাগরের পানিতে আঘাত করতেই ১২টি গোত্রের জন্য ১২টি প্রশস্ত রাস্তা হয়ে গেল যা অবলম্বনে তারা সমুদ্র অতিক্রম করে সমুদ্রের অপর প্রান্তে পৌঁছে গেল। এদিকে ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী মূসা আ: এবং তাঁর অনুসারীদের অনুসরণ করে নদী অতিক্রম করছিল ১২টি রাস্তার ওপর দিয়ে কিন্তু সফল হয়নি। কারণ ফেরাউনকে তাঁর সৈন্য বাহিনীসহ আল্লাহ তায়ালা লোহিত সাগরের পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করলেন। যদ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো অহঙ্কার পতনের মূল। তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি তার মৃতদেহটাকে বিশ্ববাসীর নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত করবেন। বাস্তবে আল্লাহর বাণী সত্য হলো এবং ফেরাউনের মৃতদেহ মিসরের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে দর্শকদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে। বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও জ্ঞানী-গুণীগণের শিক্ষণীয় এবং স্মরণীয় বিষয় ফেরাউনের এই সংরক্ষিত মৃতদেহ আল্লাহর পূর্ব ঘোষণা মতে।

হে আল্লাহ! দয়া করে আপনার গোলামগণকে তাওফিক দিন অহঙ্কারী বা দাম্ভিক না হয়ে বরং হতে পারে বিনয়ী। আমীন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *