মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশে আরও নিষেধাজ্ঞার আহ্বান

Slider জাতীয়

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব ঘটনা তদন্ত করে সরকার নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত হবে না বলে মনে করেন মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্যানেল বক্তারা।

গত মঙ্গলবার ভার্চ্যুয়ালি আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্যানেল বক্তারা। তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, মানবাধিকারকর্মীসহ বিরোধীদের ওপর দমন–পীড়নের অভিযোগ এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। এসব বিষয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের আরও জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করেন।
গত মঙ্গলবার ‘হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ: অ্যান আপডেট’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল এই ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধি পরিষদের এই সংস্থা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রচার, সুরক্ষা ও সমর্থনে কাজ করে।

শুনানিতে অংশ নেওয়া মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা জানান, রাজনৈতিক সহিংসতা এখনও বেশি হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক সমাবেশ প্রায়ই আন্তঃদলীয় সহিংসতায় পরিণত হয় এবং বিরোধী দলের বিক্ষোভ প্রায়ই পুলিশি দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়।

শুনানিটি আয়োজন করেন কংগ্রেসম্যান ও টিএলএইচআরসি কো-চেয়ার জেমস পি ম্যাকগভের্ন এবং কংগ্রেসম্যান ও টিএলএইচআরসি কো-চেয়ার ক্রিস্টফার এইচ স্মিথ। শুনানি পরিচালনা করেন কংগ্রেসের আইন গ্রন্থাগারের বৈদেশিক আইন বিশেষজ্ঞ তারিক আহমেদ। শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ও এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ক্রিস্টি উয়েদা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) সিনিয়র এশিয়া গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড। এইচআরডব্লিউর জুলিয়া ব্লেকনার ছাড়া সবাই লিখিত বক্তব্য দেন।

ব্রিফিংয়ের শুরুতেই সঞ্চালক তারিক আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের একটি অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দেশটি রেকর্ড সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য কমিয়েছে। চার দশকের মধ্যে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভূতকরণ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন।’

বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক-দেশীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো গত এক দশকে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি এবং গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের কথা সামনে এনেছে। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব, সাংবাদিক-ব্লগারদের নিপীড়নসহ বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ, ইন্টারনেট–স্বাধীনতা সীমিত করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন। দেশটিতে সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী, ব্লগারদের গ্রেপ্তার-বিচারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বিশেষভাবে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ক্রিস্টি উয়েদা বলেন, ‘২০২১ সালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‍্যাব ও এর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সেই সঙ্গে চলতি বছরের মে মাসে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ভিসা নীতি ঘোষণা করে। আমরা বিশ্বাস করি, যতক্ষণ না বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের লঙ্ঘনের তদন্ত ও সমাধানের জন্য নিরপেক্ষ ও কার্যকর জবাবদিহি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত হবে না। সেই সঙ্গে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী যারা একই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, তাদের বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের মতো ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার সুশীল সমাজ সংগঠন, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং সরকারের সমালোচক বলে বিবেচিত অন্যদের নাগরিক স্থান বন্ধ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রতিশোধমূলক গ্রেপ্তার, হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শনের শিকার হয়েছে। এসব করেও কর্মকর্তারা তাদের অসদাচরণের জন্য দায়মুক্তি ভোগ করেছেন। বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের অবক্ষয় অব্যাহত রয়েছে।’

গত কয়েক বছরের তুলনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড। তিনি বলেন, ‘যদিও নির্বাচনী পরিবেশের আরও অগ্রগতি প্রয়োজন। সব রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থকের সহিংসতা এড়ানো জরুরি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীরও সব পক্ষকে রক্ষা করা জরুরি। প্রায়ই বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যায়। যেমন, সম্প্রতি ইসি যে দলগুলোকে নিবন্ধন দিয়েছে, তারা অপরিচিত। আর পরিচিত ও সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন না দিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করেছে বলে মনে হয়।’

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিরোধী দলের হাজারো কর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে মামলা রয়েছে। যদিও বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সব নাগরিকের প্রতি আইনের সমান প্রয়োগ হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব এড়ানো অপরিহার্য।’

জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বাংলাদেশি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক দেশটির সর্বশেষ দুটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮ সালের) খুবই ত্রুটিপূর্ণ, সহিংসতাপূর্ণ ও অনিয়মে ভরা ছিল বলে মনে করেন। যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার।’

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ও এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ২ হাজার ৬৮৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রয়েছে। ২০২১ সালে ১০৭ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হলেও ২০২২ সালে এ সংখ্যা ৩১-এ নেমে এসেছে। আর চলতি বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ৮ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে।’ বাংলাদেশিরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন তা থেকে বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্রের টম লেনটস মানবাধিকার কমিশনকে তার ক্ষমতার সম্পূর্ণ প্রয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশিরা যে মানবিক মূল্য পরিশোধ করছে তা কমাতে আমরা মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশনকে অনুরোধ করব তারা যেন তাদের পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *