আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পদ্ধতি মেনে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দাতা সংস্থাটির ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুসারে দেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের (জিআইআর) পরিমাণ এখন ২ হাজার ৩৫৬ কোটি ৭৫ লাখ বা ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান হিসাবে দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৯৯৭ কোটি ৩৪ লাখ বা ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘উইকলি সিলেকটেড ইকোনমিক ইনডিকেটরস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে রিজার্ভের এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এদিকে আইএমএফের পক্ষ থেকে জুনের মধ্যে দেশের নিট রিজার্ভ (এনআইআর) রাখার যে ফ্লোর দেওয়া হয়েছিল সেটি অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। গত জুনে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি ছিল বলে জানা গেছে। নিট রিজার্ভের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করবে না বলে আগেই জানিয়েছেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, আইএমএফের পরামর্শের অনেক আগে থেকেই জিআইআর ও এনআইআর এ দুই পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখনো সেই নিয়মেই রিজার্ভের হিসাবায়ন অব্যাহত আছে। তবে এ দুটি পদ্ধতির বাইরেও সংশ্লিষ্ট সকল প্রকাশনা ও বিবরণীতে আইএমএফের বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুসারে জিআইআর হিসাব দেখানো শুরু হয়েছে। তবে বিপিএম-৬ অনুসারে এনআইআর হিসাব প্রকাশে সংস্থাটির পক্ষ থেকে কোনো শর্ত নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান পদ্ধতিতেই এনআইআর হিসাব দেখানো হচ্ছে, তবে সেটি আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করা হবে না।
জানা যায়, রিজার্ভের অর্থে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ও লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) শীর্ষক তহবিল গঠন করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনে (আইটিএফসি) আমানত হিসেবেও রাখা হয়েছে রিজার্ভের অর্থ। এ ছাড়া রিজার্ভ থেকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে (এসবিএফএফ) পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমানকে অর্থায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলংকাকে দেওয়া হয়েছে ঋণ। গত ১২ জুলাই বুধবার পর্যন্ত এসব জায়গায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ৬ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-৬) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, এসব দায় রিজার্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে না। সংস্থাটির ভাষায় এগুলো নন লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ। তাই রিজার্ভ থেকে এসব অর্থ বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ দেখানোর পরামর্শ দিয়ে আসছিল আইএমএফ। সর্বশেষ সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল, বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুসারে জুলাই থেকে দেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের (জিআইআর) হিসাবায়ন দেখাতে হবে। সে অনুযায়ী, গত ১৮ জুন চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ১ জুলাই হতে আইএমএফের পদ্ধতিতেও রিজার্ভের হিসাব দেখানো হবে বলে ঘোষণা দেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। তবে একই অনুষ্ঠানে নিট রিজার্ভের হিসাব (এনআইআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করবে না বলে জানান তিনি। যদিও ওই ঘোষণার অনেক আগেই বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুসারে রিজার্ভের হিসাবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ চূড়ান্তকরণের বিষয়ে গত ৬ জুন অনুমোদন প্রদান করেন গভর্নর। একই সঙ্গে রিজার্ভ হিসাবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিবরণী, লেখনী, আউটপুট ও প্রকাশনায় এ বিষয়ে সংশোধনী আনয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি। গভর্নরের নির্দেশনার আলোকে গত ১৩ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্তকরণ বিষয়ক এক মতবিনিময়সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় রিজার্ভ হিসাবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল বিভাগের স্টেটমেন্ট, লেখনী, আউটপুট ও প্রকাশনায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী, ১ জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল বিবরণী ও প্রকাশনায় বিবিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুসারে রিজার্ভের তথ্যে সংশোধনী আনা হয়েছে।
সূত্রগুলো বলছে, ২০২১ সালের ৩-১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ পরিদর্শনের ভিত্তিতে আইএমএফের প্রেরিত সেফগার্ড অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে রিজার্ভের অর্থে গঠিত তহবিল ও ঋণের দায় বাদ দেওয়ার জন্য প্রথমবার সুপারিশ করা হয়। সে সময় এসব দায়ের পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৭১৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার।
এদিকে জুনের মধ্যে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ (এনআইআর) ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত ছিল আইএমএফের। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত জুনে এই ফ্লোরের ঘরে রিজার্ভ উন্নীত করতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। গত জুনে দেশের নিট রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়নের কিছু বেশি। বর্তমানেও এনআইআর ২০ বিলিয়নের ঘরেই রয়েছে। আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী এনআইআর হিসাবে আগামী ৬০ দিনে পরিশোধ করতে হবে এমন দায়ও রির্জাভ থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হয়। এসব দায়ের মধ্যে আছে- এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পাওনা, ফরেন কারেন্সি ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট, এসডিআর অ্যলোকেশন, আইএমফের ট্রাস্ট ফান্ড (ইসিএফ) ও জাপানের ডেট রিলিভ গ্যারান্টের অর্থ। এসব দায়বাবদ বর্তমানে সাড়ে ৩ বিলিয়নের মতো ঋণ রয়েছে।
এর আগে গত মার্চে সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ রাখার শর্তও পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। এ ছাড়া আগামী সেপ্টেম্বরে নিট রিজার্ভের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে আইএমএফ। সংশ্লিষ্টরা জানান, জুনে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেও আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ন্যূনতম রিজার্ভ রাখার শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে, তা না হলে সংস্থাটির অনুমোদিত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে।