মাদকে বাড়ছে খুনোখুনি ভাঙছে পরিবার

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিলেন নাইম। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে কৌতূহলের বশে মাদক নেয়। এর পর ফেনসিডিল, প্যাথেডিন, ইয়াবায় আসক্ত হওয়ার পর মাদকাসক্তি থেকে ফেরাতে পরিবার বিয়ে করায়। তার পরও মাদক থেকে না ফেরায় মালয়েশিয়ায় পড়তে পাঠায় পরিবার। সেখানে গিয়ে আসক্ত হয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথে (আইস)। পরিবারের বড় সন্তান মাদকাসক্ত হওয়ায় মা-বাবা ও ভাইবোনদের পড়তে হয় লাঞ্ছনায়। মাদকাসক্ত সন্তানের জন্য ঢাকার জমিজমাসহ কোটি টাকার সম্পদ বিক্রি করে দেয় পরিবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চমৎকার মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারটি ভেঙে গেছে।

নাইমের স্ত্রী আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, শতচেষ্টা করেও তার স্বামীকে মাদক থেকে ফেরাতে পারেননি। তার স্বামী মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। সন্তান, পরিবার ও সমাজের দিকে তাকিয়ে তিনি ডিভোর্স দিতে পারছেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছরের ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস বাংলাদেশে ঘটা করেই পালন করা হয়। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ‘যুদ্ধে’ অনেক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। তবে এখনো দেশের অন্যতম প্রধান ঘাতক মাদক। তরুণ-তরুণী থেকে সব শ্রেণিপেশার মানুষ মাদকে জড়িয়ে পড়েছে। মাদকের কারণে খুনাখুনিসহ সব ধরনের অপরাধ বাড়ছে। অনেক পরিবার ভেঙে পড়ছে। মাদকাসক্তের ৮০ শতাংশই তরুণ-তরুণী; ৮৫ শতাংশ মাদকাসক্ত ইয়াবা গ্রহণ করেন। গত পাঁচ বছরে মাদকাসক্ত বেড়েছে তিনগুণ; আগামী বছর কোটি ছাড়াবে।

মাদকের কারণে খুনোখুনিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বাড়ছে। ঢাকার সাভারের হেয়ামেতপুরে মাদক সেবনের প্রতিবাদ করায় শ্বাসরোধ করে লাকী খাতুন নামে এক তরুণীকে হত্যা করে তার প্রেমিক রিপন হোসেন (২৮)। গত ২ জুন সকালে সাভারের হেমায়েতপুরের জয়নাবাড়ি এলাকার একটি বহুতল ভবনের পাশে কলাগাছের সঙ্গে লাকী আক্তারের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার ১৪ দিন পরে খুনিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

গত ২৫ অক্টোবর টাঙ্গাইল পৌর শহরের এনায়েতপুর এলাকায় সালমা বেগমকে (৫০) কুপিয়ে হত্যা করে মাদকাসক্ত সন্তান আবুল কালাম (৩০)। মাদকের টাকা না দেওয়ায় মাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ৫ মে গাজীপুরে ঘটে হৃদয়বিদারক ঘটনা। মাদকাসক্ত ছেলে আশরাফুল আলমের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কুপিয়ে সন্তানকে হত্যা করে বৃদ্ধ বাবা ওমর ফারুক সবুজ।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন আমাদের সময়কে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব। মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি অনেক আসামিকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে মাদকের চাহিদা থাকলে সরবরাহও থাকবে। তাই মাদকের চাহিদা বন্ধ করার জন্য মাদকবিরোধী র‌্যালি ও সেমিনার করছে র‌্যাব। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করা হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মাদকদ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ৭৯টি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৪৩ জন। এ সময়ে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৬টি। ২০০৯ সালে মাদকের মামলা ছিল ২৭ হাজার ৪৪১টি; আসামি ছিল ৩৪ হাজার ৩১৫ জন। ২০২২ সালে মামলা হয় ১ লাখ ৩২১টি; আসামি করা ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ জনকে।

২০০৯ সালে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ২৮৭ পিস। এরপর ২০২০ সাল পর্যন্ত ইয়াবা উদ্ধার বাড়তে থাকে। এরপর আবার কমতে থাকে। ২০২০ সালে উদ্ধার হয় হয় ৫ কোটি ৩০ লাখ ইয়াবা। পরের বছর উদ্ধারের পরিমাণ কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৪ কোটি ৫৮ লাখে। ২০২২ সালে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৭ লাখে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবা উদ্ধার কমে যাওয়া মানে মাদকের ব্যবহার কমেছে, বিষয়টা এমন নয়। ইয়াবাসেবীরা এখন আইস সেবন করে। আর মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্রি করার চেয়ে ইয়াবার কাঁচামাল ক্রিস্টাল মেথ নিয়ে আসা হয়। এরপর দেশেই তৈরি হয় ইয়াবা।

কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে প্রায় তিন কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমার থেকে নাফ নদী পেরিয়ে গত দেড় দশক ধরে শুধু ইয়াবা আসত দেশে। তবে এখন পাল্লা দিয়ে ভয়ংকর মাদক আইস বা ক্রিস্টাল মেথ দেশে ঢুকে। বিভিন্ন সময় অভিযানে ভয়ংকর এসব মাদকের বাহকরা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতা ও মাদককারবারির পৃষ্ঠপোষকরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (্এসপি) মো. মাহফুজুল ইসলাম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, কক্সবাজার জেলায় মাদক মামলা তুলনামূলক বেশি। মাদক প্রতিরোধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে মাদকের কুফল বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। ইমাম সাহেবরা মাদকের কুফল তুলে ধরছেন। স্কুল-কলেজে গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা মাদকের কুফল নিয়ে কথা বলছেন। জনপ্রতিনিধিদের মাদকের বিরুদ্ধে সজাগ হওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া বিট পুলিশিং ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মাদকের কুফল বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগও অব্যাহত আছে। তবে মাদক প্রতিরোধ করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সব শ্রেণির মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

সরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ থেকে ৮০ লাখ। পাঁচ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ লাখ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে মাদক আইনের মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার পুরনো কারবারে জড়াচ্ছেন। মাদককারবারিদের কঠোর সাজা হলে তাদের মধ্যে ভয় তৈরি হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ৮ জুন এক প্রতিবেদনে বলছে, মাদকের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা পাচার হয়। মাদক চোরাকারবার থেকে অর্থ পাচারে বাংলাদেশ এশিয়ায় প্রথম, বিশ্বে পঞ্চম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *