কমে যাবে অর্থের প্রবাহ আরও দামি হবে ঋণ

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের সীমা তুলে দিয়ে এর পরিবর্তে নতুন নিয়মে তা নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক ঋণ আগের চেয়ে দামি হয়ে উঠবে, তথা সুদহার বাড়বে। সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে সুদহার করিডর ব্যবস্থা চালুর নতুন ব্যবস্থাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘শর্টটার্ম মান্থলি এভারেজ রেট’ বা স্মার্ট। এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স রেট। এর সঙ্গে ব্যাংকের সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করলে তা সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১২ শতাংশে দাঁড়াবে। এতদিন ঋণের সুদে সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৯ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে বেশ লাগাম টানা হয়েছে, তবে বাড়ানো হয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি।

গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। তিনি এবারের মুদ্রানীতিকে সঙ্কোচনমূলক ও আঁটসাঁট ভঙ্গির মুদ্রানীতি হিসেবে উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে নতুন মুদ্রানীতির মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। এ সময় ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউয়ের প্রধান কর্মকর্তা, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, মুদ্রানীতি বিভাগের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ব্যবহার হয়। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কতটা ভূমিকা রাখবে,

সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে শুধু অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধিই দায়ী নয়, আমদানি ব্যয়বৃদ্ধি ও পণ্যের সরবরাহজনিত ঘাটতিই দায়ী। এ ছাড়া এখনো ডলারের সংকট রয়েই গেছে। ক্রমাগত অবমূল্যায়ন হচ্ছে টাকার। এর মধ্যে ঋণের সুদ বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে। এতে পণ্যের মূল্য না কমে, উল্টো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনা নির্ধারণ করছে সরকার। নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ জন্য নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এর মাধ্যমে বাজারের মুদ্রার সরবরাহ কমবে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় এই সিদ্ধান্ত কাজে আসবে বলে আশা করা যায়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তগুলোর অন্যতম হলো সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা। বিশেষ করে ব্যাংকের সুদহার নির্দিষ্ট করে না রেখে করিডর প্রথা চালু করে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কাঠামো পরিবর্তন করে সুদহারের করিডর প্রথা চালু করা। সেই সঙ্গে আইএমএফের স্বীকৃত বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুসারে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব গণনা করা। আইএমএফের এসব শর্ত পরিপালনের প্রতিফলন দেখা গেছে নতুন মুদ্রানীতিতে।

এতে সুদহার বাজারভিত্তিক করতে দুই রকম করিডর ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটা হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের বিতরণ করা ঋণের সুদহার। এটাকে রেফারেন্স রেটসহ করিডর বলা হবে। অপরটি হবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেওয়া-নেওয়ার সুদহার। এটাকে বলা হবে পলিসি রেটসহ করিডর, যা মুদ্রানীতি পরিচালনার টুলস হিসেবে ব্যবহার হবে।

এতদিন রিজার্ভ মানিকে অপারেটিং টার্গেট বিবেচনায় নিয়ে বাজারে অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে মুদ্রানীতির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তবে আগামী অর্থবছর হতে এই ব্যবস্থা পরিবর্তন করে মুদ্রানীতির অপারেটিং টার্গেট হিসেবে সুদহারকে বিবেচনায় নেওয়ার ঘোষণা এসেছে। এর মাধ্যমে বাজারে অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এ ছাড়া নতুন মুদ্রানীতিতে আইএমএফের ম্যানুয়াল অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে রিজার্ভের হিসাবায়ন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বাজারভিত্তিক বৈদেশিক বিনিময় হার চালুর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

মুদ্রানীতিতে আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত পূরণ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, সস্তা ঋণ নিতে হলে কিছু শর্ত তো মানতেই হবে। তবে এটাকে আমি শর্ত বলি না, আইএমএফের স্ট্যান্ডার্ড বলি। যেসব দেশ আইএমএফের সদস্য, তারা তাদের স্ট্যান্ডার্ড মেনেই চলে। সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ব্যাংক ঋণের ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। এই সীমা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও রাজনৈতিক। আমাদের কৃতিত্ব, আমরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। যখন এই সীমা দেওয়া হয়েছিল, তখন ব্যাংকগুলোর সুদ ১৮ শতাংশে উঠেছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল ২ শতাংশ। এখন বিদেশি ঋণের সুদ ৯-১০ শতাংশ। আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তার খরচ আরও বেশি হয়ে যাচ্ছে।

গভর্নর জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ‘দুই পদ্ধতিতেই’ করবে। অর্থাৎ আগে যে পদ্ধতিতে করা হতো, সেভাবেও করা হবে, আবার আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতেও করা হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হবে। পৃথিবীর কোনো দেশ তা প্রকাশ করে না। আইএমএফের এ বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।

মুডিসের রেটিং নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, মুডিস কর্তৃক দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাম্প্রতিক অবনমন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য খুব বেশি গুরুত্ব রাখে না। মুডিস আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর যে রেটিং করেছে, এটা মনে হচ্ছে ভূরাজনৈতিকভাবে হয়েছে। এটা খাঁটি অর্থনৈতিক রিপোর্টিং নয়।

সীমা প্রত্যাহার করে নতুন নিয়মে সুদ নির্ধারণ : আগামী জুলাই থেকে ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে একটি সুদহার করিডর ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নতুন এ ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শর্টটার্ম মান্থলি এভারেজ রেট’ বা স্মার্ট। এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের (১৮২ দিন) ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স রেট। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। আর ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে। আর কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাত ও ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ সামাল দিতে আরও ১ শতাংশ যোগ করতে পারবে সুদ হারে।

গত ছয় মাসে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার রয়েছে ৭ দশমিক ১২ শতাংশ। ফলে এর সঙ্গে ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করে ঋণের সুদ নির্ধারণ করলে তা সর্বোচ্চ হবে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। এতদিন ঋণের সুদে সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৯ শতাংশ। এর মানে আগামী অর্থবছরের ১ জুলাই থেকেই ঋণের সুদহার দুই অঙ্ক দিয়ে শুরু হবে। ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ওঠা-নামা করলে ঋণের সুদহারও ওঠা-নামা করবে। এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, রেফারেন্স রেটের সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করে যে সুদের হার হবে, সেটিই হবে ঋণের সর্বোচ্চ হার। এর চেয়ে বেশি সুদে কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করতে পারবে না। তবে কেউ চাইলে এর কম সুদেও ঋণ দিতে পারবে।

বাড়ানো হলো নীতি সুদহার : নতুন মুদ্রানীতিকে নীতি সুদহার বা রেপো হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। আর রিভার্স রেপো হার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। একদিন মেয়াদি রেপো ও রিভার্স রেপোর এই নতুন হার ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে। তার আগেই এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করা হবে। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। রেপো রেট বৃদ্ধি করায় ব্যাংকগুলোর অর্থ নেওয়ার খরচ বাড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে। এদিকে এখন থেকে রেপো ও রিভার্স রোপোকে বলা হবে স্ট্যান্ডার্ড ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ)। আর স্পেশাল রেপোকে বলা হবে স্ট্যান্ডার্ড ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ)।

কমবে অর্থের প্রবাহ : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থের সরবরাহও কমানো হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে। আগামী ছয় মাস রিজার্ভ মানির সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা শূন্য ধরা হয়েছে। এর মানে আগামী ছয় মাস রিজার্ভ মানির সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রাখা হবে। তবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত রিজার্ভ মানির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে রাখার সীমা দেওয়া হয়েছে। আগামী ছয় মাসে ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধির সীমা দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। আর আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এই সীমা দেওয়া হয়েছে ১০ শতাংশ।

বেসরকারি ঋণে লাগাম, সরকারি ঋণে বৃদ্ধি : নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০.৯ শতাংশ। আর আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ধরা হয়েছে ১১ শতাংশ। চলতি মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ। অন্যদিকে নতুন মুদ্রনীতিতে ব্যাংক ব্যবস্থা নেওয়া সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪৩ শতাংশ, যা চলতি মুদ্রানীতিতে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬.৯ শতাংশ, চলতি মুদ্রানীতিতে যা ধরা হয়েছিল ১৮.৫ শতাংশ।

ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয় তার পুরোটাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয় করে। আর এডিপিতে ব্যয় মানে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বোঝায়। যদি অবকাঠামোগত সমস্যা থাকে, তা হলে বেসরকারি বিনিয়োগও নিরুৎসাহিত হয়। আর এ কারণেই আমরা সরকারি বিনিয়োগ কমানোর পক্ষে নই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *