পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

যে মানুষটি সব ভরসার আশ্রয়স্থল, যে হাত পরম মমতায় আগলে রাখার- সেই মানুষের সেই হাতই হয়ে যাচ্ছে নৃশংস খুনি। মুহূর্তের ক্রোধে শেষ হয়ে যাচ্ছে সাজানো সংসার। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হাতে খুন হচ্ছেন; মা-বাবা হত্যা করছেন সন্তানকে কিংবা সন্তান হত্যা করছে মা-বাবাকে; ভাইয়ের রক্ত নিয়ে খেলছে ভাই। ক্রমেই বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা।

মূল্যবোধের অভাব, পারস্পরিক সহনশীলতা হ্রাস, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে এ ধরনের প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। পারিবারিক সহিংসতার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হত্যাকা-গুলোর মূল কারণ দাম্পত্য কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদকাসক্ততা, অর্থের নেশায় প্রিয়জন হয়ে যাচ্ছেন খুনি।

রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে স্ত্রী মাহমুদা হক বৃষ্টি ও তার মেয়ে সানজা মারওয়াকে খুন করেন মোহাম্মদ সেলিম। সেলিমের পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় খুন হতে হয় তার স্ত্রী ও মেয়েকে। রাজধানীর দক্ষিণখানের নিজ বাড়িতে সম্প্রতি মোছা. আফরোজাকে খুন করে কানাডায় ফিরে যান তার স্বামী প্রবাসী আশরাফুল ইসলাম। শুধু বৃষ্টি-সানজা বা আফরোজাই নন, পারিবারিক সহিংসতায় বলি এমন আরও অনেকেই। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে পারিবারিক সহিংসতায় খুন হয়েছেন ১৭৮ নারী। তাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৯ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ৮৯ জন, স্বামীর পরিবারের হাতে ২৩ জন এবং নিজ পরিবারের হাতে খুন হয়েছেন ১১ নারী। পারিবারিক সহিংসতার জেরে আত্মহত্যা করেছেন ৫৫ নারী।

পারিবারিক সহিংসতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সাময়িক ক্রোধ বা লোভের বশবর্তী হয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন হলে সন্তানরা মা-বাবা দুজনকেই হারায়। কারণ মা-বাবার মধ্যে একজন খুন হলে অন্যজন চলে যান কারাগারে। ফলে সন্তানরা একা হয়ে যায়। এতে করে ওদের যে মানসিক ক্ষতি হয়, সেটা অপূরণীয়; তাদের ভবিষ্যৎ ঢেকে যায় অনিশ্চয়তার কালো মেঘে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের সমাজ পরিবারকেন্দ্রিক। কিন্তু পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের দেশের কোনো পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেই। যেসব পরিবার সংকটের মধ্যে রয়েছে, তারা কোথায় যোগাযোগ করবে? তিনি বলেন, পরিবার একটি আদর্শ জীবন ব্যবস্থার নাম। তাই পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। স্কুল-কলেজে পরিবারের গুরুত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরির বিষয়ে কাজ করা দরকার। এ বিষয়ে পাঠ্য থাকা প্রয়োজন।

পারিবারিক সহিংসতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. তৌহিদুল হক বলেন, পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত থাকলে এ ধরনের সহিংসতা বাড়ে। এতে করে পরিবারগুলো ভেঙে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে পরিবারের সদস্যদের একত্রে সময় কাটানো কমে যাচ্ছে, তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। একই কারণে বন্ধুত্বের নামে অনাকাক্সিক্ষত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাড়ছে। ফলে পরিবারের মধ্যে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে স্বামী সময় দিতে পারছেন না স্ত্রী ও পরিবারকে। আবার স্ত্রীও তার স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের ঠিকমতো সময় দিচ্ছেন না। ফলে তাদের সম্পর্কের বন্ধনের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, পরিবারে হত্যাকা- ঘটলে সন্তানরা মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত হয়। তারা পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরিবারের মধ্যেই তারা বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে। আর পরিবারের বাইরে, অন্য মানুষজনও তাদের সঙ্গে অপমানসূচক মন্তব্য করে। সন্তানরা ঘরে-বাইরে কোথাও প্রশান্তি পায় না। ফলে ওদের মধ্যে একাকিত্ব তৈরি হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। মামলাগুলোর বড় অংশই অবশেষে সমঝোতায় শেষ হয়। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শুরুতে যে মানসিক দৃঢ়তা থাকে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে, সেটা কেটে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৫-৭ বছর পর তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে মামলা তুলে নেয়।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজ ও পরিবারের মধ্যে স্বার্থপরতা বাড়ছে। বর্তমান সময়ে অপরাধের ধরনেও ভিন্নতা এসেছে। অনৈতিক ও আপত্তিকর কর্মকা-ে মানুষের আসক্তি বাড়ছে। এসবের কারণে শিশু হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো অপরাধ বাড়ছে। পারিবারিক ও সামাজিক কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে এ ধরনের সহিংসতা দূর করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।

নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার মূল ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। নারীর প্রতি সহিংসতার নেপথ্যে মূল কারণ হচ্ছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এ ক্ষেত্রে এমন অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য প্রথম প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নারীকে ছোট করে দেখার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচানো, সুরক্ষা দেওয়া, বিবাহিত নারীর সংসার টেকানোর উদ্দেশ্যেই ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে আইনি জটিলতা, মামলায় দীর্ঘসূত্রতা, সহিংসতা রোধে নির্যাতিতের মামলা দায়েরে আইনি সীমাবদ্ধতা ও প্রচারের অভাবে আইনের সুফল মিলছে না। নারী নির্যাতন বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি বলে মনে করেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *