বিএনপি এবং সমমনা জোট ও দলগুলোর চলমান যুগপৎ আন্দোলনের মধ্যে মাঠে নামছে জামায়াতে ইসলামীও। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে দলটি। এই আন্দোলনের মাঠ থেকে বিএনপি ও জামায়াতের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব জোড়া লাগার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নে উভয় দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যোগাযোগও হচ্ছে। ‘সরকার পতনের এক দফা এবং রাষ্ট্র মেরামত’র রূপরেখা চূড়ান্ত করা নিয়ে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে উভয় দলের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়া রাজপথের বড় শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে জামায়াত।
এদিকে চলমান আন্দোলনকে তীব্র করতে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের যৌথ উদ্যোগে আগামী ১০ অথবা ১১ জুন চট্টগ্রামে তরুণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এই সমাবেশের পর বিএনপিও কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এখন পর্যন্ত পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে রোডমার্চ অথবা বিভাগীয় সমাবেশসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, কর্মসূচি চূড়ান্ত হলে আগামী ১৩ থেকে ১৫ জুনের মধ্যে নতুন কর্মসূচি শুরু করতে পারে বিএনপি।
অন্যদিকে, গতকাল ৫ জুন জামায়াতের রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশের অনুমতি না মেলায় এ কর্মসূচি স্থগিত করে দলটি। এ অবস্থায় আগামী ১০ জুন শনিবার নতুন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় জামায়াত।
এ অবস্থায় বিএনপির চলমান আন্দোলনে জামায়াত যুক্ত হবে কিনা জানতে চাইলে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আমাদের সময়কে বলেন, এই নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের কার্যকরী পর্যায়ে যোগাযোগ হচ্ছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
জামায়াত ও বিএনপির মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিএনপির কোন পর্যায়ের সঙ্গে জামায়াতের যোগযোগ হচ্ছে, তা জামায়াতই ভালো বলতে পারবে। আর আমি একা বিএনপিতে আছি এমন তো নই।
তবে, বিএনপির ঘনিষ্ট সূত্র বলছে, একটি প্রক্রিয়া চলছে। তা হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলন করা নিয়ে। পৃথক প্ল্যাটফর্ম থেকে বিএনপি ও জামায়াত আন্দোলন করবে।
২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। সেই বিতর্ক বিএনপির পিছু ছাড়ছে না। এরপর চারদলীয় জোট ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত করা হয়। দেশি-বিদেশি নানা মহলের চাপ এবং ‘বিএনপি-জামায়াত’ তকমা মুছতে দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা চালায় বিএনপি। এ কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়। এ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। এ অবস্থায় উভয় জোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে পথ চলতে শুরু করে বিএনপি। সর্বশেষ গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশের একদিন আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়। এই সমাবেশ থেকে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা ঘোষণা করে যুগপৎ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। পরে সংবাদ সম্মেলন করে রাষ্ট্র মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখাও ঘোষণা করে দল।
বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমমনা দল ছাড়াও জামায়াতও কর্মসূচি দেয়। রাজধানী ঢাকায় ৩০ ডিসেম্বর মালিবাগ মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় জামায়াত। এ ঘটনায় বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে কোনো বিবৃতি না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। এরপর যুগপৎ কর্মসূচিতে জামায়াতকে অংশ নিতে দেখা যায়নি।
জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, জামায়াত জোট করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। তিনি কোথায় কী অবস্থায় আছেন, তা সবার জানা। জামায়াত নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে নানা অপপ্রচার আছে। এগুলো আমরা দূর করার চেষ্টা করছি। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের অবহিত করেছি।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, ১০ দফা দাবি আদায়ে দেশের সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ দেশের সবাইকে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। তবে জামায়াতের সঙ্গে সম্প্রতি কোনো বৈঠক হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
জামায়াতের সংবাদ সম্মেলন : রাজধানীতে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচির অনুমতি না পেয়ে গতকাল ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াত। এতে কেন্দ্রীয় প্রচার সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ লিখিত বক্তব্য পড়েন। তিনি বলেন, আমরা সংঘাত-সংঘর্ষ চাই না; আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
অনুমতি না পাওয়ায় গতকাল ৫ জুনের (পূর্ব ঘোষিত) কর্মসূচি স্থগিত করে আগামী ১০ জুন শনিবার রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে দুপুর ২টায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন মতিউর রহমান আকন্দ। ঘোষিত কর্মসূচির জন্য ডিএমপির কাছে অনুমতি চেয়ে ই-মেইলে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, দেশের মানুষ সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐকমত্য পোষণ করে এ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে একতরফা ও নিশি রাতের ভোটের পর, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে বলে জনগণ বিশ্বাস করে না।
গত ১৫ বছর ধরে রাজপথে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে এই জামায়াত নেতা বলেন, গত ২৮ মে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিকট অনলাইনে ৫ জুন সমাবেশের জন্য আবেদন করে। ২৯ মে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের ৪ জন আইনজীবীর একটি প্রতিনিধি দল ৫ জুন সমাবেশ করার আবেদন নিয়ে ডিএমপি কমিশনারের নিকট গেলে কমিশনার কার্যালয়ের গেট থেকে তাদের আটক করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুই দফা সমাবেশ করার জন্য সহযোগিতা চেয়ে ডিএমপিতে আবেদন করা হয়। প্রশাসন কোনোটার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেনি। বরং প্রতিবাদ জানাতে বিক্ষোভ করলে পুলিশ সেখানে চড়াও হয়।
মতিউর আকন্দ বলেন, জনগণের অধিকার আদায়ে সুনির্দিষ্ট ৩টি দাবিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, নেতাদের মুক্তি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করতে চায় জামায়াতে ইসলামী। গোয়েন্দা প্রধান এখানে কিসের অসৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন? রাষ্ট্রের সেবক হয়ে অসত্য কাল্পনিক কথা বলে রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি।