অর্থছাড় না হওয়ায় বিদ্যুতের সংকট

Slider জাতীয়

বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। অন্যদিকে সব মিলিয়ে পুরো দেশের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৫ হাজার মেগাওয়াট। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এরপরও কেন বিদ্যুৎ সংকট? কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাব। জ্বালানির কেন অভাব? কারণ, অর্থের সংকট। এরই মধ্যে আমদানিকৃত জ্বালানির বিপরীতে বিল বকেয়া পড়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। কেন অর্থের সংকট? কেন এতো টাকা বকেয়া পড়েছে? কারণ, প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। ক্ষেত্রবিশেষে ছাড় করলেও সময় অনেক বেশি ক্ষেপণ হচ্ছে। ফলে যথাসময়ে জ্বালানির জোগান পাচ্ছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো; বন্ধ রাখতে হচ্ছে উৎপাদন। মূলত এ কারণেই এমন তীব্র গরমের মধ্যেই বিদ্যুৎসংকট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে যারপরনাই বিপাকে আছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কয়লা-গ্যাস-তেল না থাকায় বাধ্য হয়ে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিভাগ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রস্তুত। সংকট হলো অর্থের। কারণ জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ ছাড় করলেও সেটা সময়ক্ষেপণ করে করছে। ফলে সময়মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি এসে পৌঁছানো যাচ্ছে না। যার কারণে বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানির জন্য প্রায় দুই মাস আগে থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দেন-দরবার করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সময়মতো অর্থ ছাড় এবং প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান না করার কারণে পায়রা প্রায় তিন সপ্তাহের জন্য বন্ধ করতে বাধ্য হলো। ওই কর্মকর্তা বলেন, আরও আগে অর্থছাড় বা

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হতো না। বিদ্যুতের এ অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় দরকার। জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণেও সংকট তৈরি হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জ্বালানি আমদানি বাবদ এই মূর্হতে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বকেয়া জমা পড়েছে। যার মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরাই পাবেন ১৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, তেল সরবরাহকারীদের প্রাপ্য বকেয়া প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য খাত মিলিয়ে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার দরকার। তবে জ্বালানি বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি হলেও সময়মতো অর্থ ছাড় হচ্ছে না।

পর্যাপ্ত ডলার সংকটে সময়মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রচ- দাবদাহে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা বলছে এ সংকট খুব সহসা কেটে যাবে এমন আশা করাও কঠিন। কারণ এরই মধ্যে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের মতো বকেয়া পড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশ (বিপিসি), বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি (আইওসি) সবাই টাকা পাবে। ফলে এই মুহূর্তে ডলার সংকটই সবচেয়ে বড় সমস্যা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের একজন জৈষ্ঠ্য কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- মূলত অর্থ সংকট। পর্যাপ্ত ডলার প্রাপ্তির সংকট। ওই কর্মকর্তা বলেন, মানুষকে স্বস্তিদায়ক বিদ্যুৎ সরবরাহের সব প্রস্তুতি বিদ্যুৎ বিভাগের আছে। কিন্তু সময়মতো ডলার সংস্থান বা অর্থ যদি না পাওয়া যায় তাহলে জ্বালানি আমদানি নিশ্চিত করা যাবে না। বিদ্যুৎ সংকট থেকেই যাবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বারবার যোগাযোগ করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো অর্থ ছাড় মিলে না। ওই কর্মকর্তা বলেন, দুটো মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি।

সর্বশেষ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন- তীব্র গরম এবং সে সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে সবার প্রচ- কষ্ট হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি কারোই কাম্য নয়। অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিংয়ের পেছনে বেশকিছু কারণ আছে, যা সবারই জানা প্রয়োজন।

প্রতিমন্ত্রী আরও লিখেছেন- আপনাদের অজানা নয়, করোনা মহামারীর ধাক্কা, পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ^ জ্বালানি বাজারে ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস ওয়েলসহ সব ধরনের জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, সে সঙ্গে প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যে সংকট এখনও চলমান। অন্যদিকে, টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি যথা- গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস ওয়েল আমদানিতে অনেকটা প্রভাব পড়েছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমানের এই অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং। তবে আমরা খুব দ্রুতই জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। আশা করি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে।

প্রতিমন্ত্রী তার স্ট্যাটাসে আরও বলেছেন, আপনারা জানেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অবিচল নেতৃত্বে দিন-রাত পরিশ্রম করে আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। ২০০৮ সালেও মাত্র ৪৪ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পেতেন, সেখানে আজ শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, যা বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় নজিরবিহীন ঘটনা। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে জাতীয় অর্থনীতি ও সব ধরনের উৎপাদনে অভাবনীয় গতি এসেছে। এতে দেশজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিগত এক যুগে আমরা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছি ৫ গুণেরও বেশি। বর্তমানে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭,৩৬১ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভসহ)। ফলে উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতির কারণেই আমরা এই অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছি।

আমি সর্বোপরি আপনাদের ভোগান্তিতে দুঃখ প্রকাশ করছি। সেসঙ্গে আশ্বস্ত করতে চাই, এ পরিস্থিতি সাময়িক। খুব দ্রুতই আমরা ভালো অবস্থায় ফিরে আসবো। তিনি আরও লিখিছেন, অনেকের মনে থাকার কথা ২০০৮ সালের আগে সারাদেশে দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আশা করি আপনাদের সে আস্থা ও সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সবাই মিলে আমরা দ্রুততম সময়ে এই ভোগান্তি পাড়ি দিতে সমর্থ হবো।

উল্লেখ্য, ডলার সংকট তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। সময়মতো জ্বালানি আমদানির বিল পরিশোধ করতে না পারায় পেট্রোবাংলা এরই মধ্যে জরিমানাও গুনেছে। ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় প্রথমে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল। পরে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ হয়ে যায়। তেল আমদানির বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি। পেট্রোবাংলার কাছে এলএনজি আমদানির বিল, এলএনজি টার্মিনালের চার্জ এবং দেশের অভ্যন্তরে কাজ করা বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো (আইওসি) প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা পাবে। ডলার সংকটে আমদানি করা জ্বালানির মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না বিপিসি। এতে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তেলবাহী কার্গো না পাঠানোর কথাও জানিয়েছে বিপিসিকে। সূত্রের খবর, প্রায় ২৩ মিলিয়ন ডলার বা ২৩ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে বিপিসির। বিপিসি জ্বালানি বিভাগকে জানিয়েছে, বকেয়া বিলের কারণে জ্বালানি সরবরাহে অনীহার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিলম্বে আমদানি মূল্য পরিশোধের জন্য বাড়তি চার্জ দাবি করছে। এমনটি চলতে থাকলে জ্বালানি তেলের সরবরাহ অব্যাহত রাখা চ্যালেঞ্জ হবে। এতে দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

একদিকে যখন দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদাও বাড়ছে। সম্প্রতি ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পোৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রেখে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে এবং এশীয় দেশগুলোয় আসতে ইচ্ছুক বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জোগান বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে যোগাযোগের খাতের বরাদ্দ থেকে কিছুটা কাটছাঁট করে হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই) ৩ জুন রাজধানীর এফবিসিসিআই কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে বলেন।

সংগঠনের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার চাইলে যোগাযোগ খাতের কিছু বরাদ্দ কমাতে পারে।’ জসিম উদ্দিন বলেছেন, দেশে যখন গ্যাস বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো ছিল, তখন বিনিয়োগ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে অনেকটা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তাহলেই শিল্পায়ন হবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *