জাকাত ট্র্যাজেডি গরিব মারার মহাউৎসব

Slider সারাদেশ


জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মানুষ মরার ট্র্যাজেডি এ দেশে নতুন নয়। প্রতিবছরই জাকাতের নামে গরিব মারার বেদনার উৎসব (?) পালন করেন সম্পদশালীরা। চলমান এই জাকাতের কাপড় দেওয়ার পদ্ধতি রীতিমতো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন জরিপে প্রকাশ, জাকাত নিতে গত ৩৫ বছরে নিহত হয়েছে ২৫৪ জন। আহতের সংখ্যা অসংখ্য। ১৯৮০ সালের রমজান মাসে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে ঢাকার জুরাইনে শিশুসহ ১৩ জন পদপৃষ্ট ও ভিড়ের চাপে নিহত হয়। ১৯৮৩ সালের ৯ জুলাই

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জাকাতের টাকা নিতে গিয়ে ভিড়ের চাপে পড়ে ৩ শিশু মারা যায়। ১৯৮৭ সালের ২৩ মে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে জাকাত দেওয়ার সময় ৪ জন মারা যায়। ১৯৮৯ সালের ৫ মে চাঁদপুরে মারা যায় ১৪ জন, ১৯৯০ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আবুল বিড়ি ফ্যাক্টরিতে ৩৫ জন, ১৯৯১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে বিড়ি ফ্যাক্টরিতে ৩২ জন, ঢাকার নবাবপুর রোডে জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে ২ জন নিহত হয়।

২০০২ সালের ডিসেম্বরে জাকাত ট্র্যাজেডি ঘটে গাইবান্ধায়। এতে ৪২ জন নিহত হয়। ২০০৩ সালে ঈদুল ফিতরের আগে রাজধানীর শাহজাহানপুরে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের বাসা থেকে জাকাত আনতে গিয়ে ভিড়ের চাপে নারী ও শিশুসহ ৯ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০০৬ সালে পটুয়াখালীতে জাকাত আনতে গিয়ে প্রাণ হারান ৩ জন। মুক্তাগাছা উপজেলায় বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিকের বাসায় জাকাত নিতে গিয়ে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জাকাত আনতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন একজন। ২০১১ সালে রমজানে রাজধানীর আকিজ গ্রুপের কার্যালয় থেকে জাকাত আনতে গিয়ে ৭ জন মারা যান। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে রাজধানীর ফকিরাপুলে তিন নারী মারা যায়। ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই বরিশাল নগরীর কাঠপট্টি রোডে খান অ্যান্ড সন্স গ্রুপের মালিকের বাসভবনে জাকাতের কাপড় বিতরণের সময় মারা যায় ২ জন। সর্বশেষ গত শুক্রবার ১০ জুলাই ২০১৫ ময়মনসিংহে ঘটে ভয়াবহ জাকাত ট্র্যাজেডি।

জনমনে প্রশ্ন উঠেছে- জাকাতের নামে মানুষ মারার এই উৎসব (?) কি ইসলামসম্মত? না ইসলামের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক? ইসলামের চেতনা হলো- দরিদ্র ব্যক্তিকে এই পরিমাণ জাকাতের অর্থ দেওয়া, যাতে দ্বিতীয়বার জাকাতের জন্য তাকে হাত পাততে না হয়। হজরত ওমর (রা) বলেছেন, যখন তোমরা অসহায়কে জাকাত দিবে তখন তাকে ধনী বানিয়ে দাও। ইমাম নববী (রা) বলেছেন, অসহায় গরিবদের এই পরিমাণ সম্পদ দান কর, যাতে তারা অভাবের গ্লানি থেকে মুক্তি পায় এবং ধনী ব্যক্তির পর্যায়ে এসে উপণীত হয়। স্বনির্ভর হওয়ার উপযুক্ত অর্থ প্রদানে অভিমত দিয়েছেন ইমাম শাফি ও অন্য ফেকাহবিদগণ [দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম, ইফা]। জাকাত প্রসঙ্গে কোরআন শরিফে আল্লাহ বলেছেন- তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত প্রদান কর আর নিজেদের জন্য কল্যাণকর যা কিছু আগেভাগে পাঠাবে তা আল্লাহর নিকট পাবে। নিশ্চয়ই আল্ল­াহ তোমাদের সব কাজকর্ম দেখছেন [সূরা বাকারা-১১০]। জাকাতের অধিকারী আট শ্রেণি মানুষ। এ বিষয়ে আল্ল­াহ বলেছেন- সদকা তো কেবল গরিব, মিসকিন এবং সদকা আদায়ে নিযুক্তদের জন্য। যাদের ধর্মের প্রতি চিত্তকার্ষণ করা হয় তাদের জন্যও। দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্ল­াহর পথ ও মুসাফিরের জন্য। এটা আল্ল­াহর বিধান, আল্ল­াহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় [সূরা তওবা-৬০]।

জাকাত প্রদানের একটি বিশেষত্ব এই যে, এটি গোপনে দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান কর, তবে তা অনেক উত্তম। আর যদি গোপনে দান কর এবং অভাবগ্রস্তদের মাঝে দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম [সূরা বাকারা-২৭১]।

হজরত আবু হুরায়রা (রা) বলেন, নবী করিম (স) বলেছেন- কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত যখন কোথাও কোনো ছায়া থাকবে না, তখন সাত প্রকারের লোক আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি এমন হবে- যে এমন গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে, তার বাম হাত জানতে পারে না যে, ডান হাত কী খরচ করল।

কোরআনুল কারিম ও হাদিসের ভাষ্য আর বাংলাদেশের জাকাত বণ্টনচিত্র পুরো উল্টো। জাকাতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে হাজার মাইল দূরে। দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, বেকার, অক্ষম জনগোষ্ঠীর আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ইসলামে জাকাতের বিধান। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, স্বনির্ভর দেশ গঠন জাকাতের প্রধান উদ্দেশ্য। দীর্ঘ বছর বিত্তবানরা জাকাত দিয়ে যাচ্ছেন। আজন্ম দরিদ ্রপরিবার জাকাত-ফেতরা কুড়িয়েই যাচ্ছেন। তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসছে না। তা হলে বাংলাদেশের চলমান ধারার জাকাত দারিদ্র্য বিমোচন করছে নাকি প্রতিবছর বিত্তবানরা জাকাত বিলিয়ে দরিদ্রের লালন করছেন? জাকাতের নামে গরিব মারার উৎসব পালন করছেন? বিবেকবান বিত্তশালীদের কাছে অনুরোধ- পরিকল্পিতভাবে ত্রুটিমুক্ত বণ্টনব্যবস্থার মাধ্যমে সঠিক তত্ত্বাবধান করে জাকাত প্রদান করুন। তা হলে জাকাতের প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *