পাঁচ সিটি নির্বাচনে রংপুরের চিত্র দেখতে চায় না আ. লীগ

Slider রাজনীতি


আসছে মে-জুন মাসের মধ্যেই দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ বিষয়ে এরই মধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। আসন্ন এসব সিটি নির্বাচনের ভোটের চিত্র রংপুর সিটি করপোরেশনের মতো হোক, এটা চায় না ক্ষমতাসীন দলটির হাইকমান্ড। নির্বাচনকালে তাই দলের সবপর্যায়ের নেতাকর্মীকে নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ রাখতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ। এখন চলছে মনোনয়নপত্র বিক্রি। ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় দলের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভায় মনোনয়ন দাখিলকারীদের মধ্য থেকে মনোনীত করা হবে দলীয় প্রার্থী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ‘ভরাডুবি’ হয়েছে, ৫ সিটির ভোটে সেই একই চিত্র দেখতে চায় না ক্ষমতাসীন দলটি। এরই অংশ হিসেবে দলীয় কোন্দল নিরসন এবং বিএনপির কৌশলের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সে মোতাবেক ৫ সিটিতে সতর্ক থাকবে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট সিটিগুলোর নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, এরই মধ্যে রাজশাহী সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং সিলেটের মেয়র প্রার্থী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে ঢাকায় ডেকে দলের হাইকমান্ড থেকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে খুলনা ও বরিশাল সিটির দুই মেয়র যথাক্রমে তালুকদার আবদুল খালেক এবং সাদিক আবদুল্লাহকে ফের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাকে শেষ পর্যন্ত নৌকার টিকিট দেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের দিকে তাই দৃষ্টি গাজীপুরের নেতাকর্মীদের।

এদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি আসন্ন ৫ সিটির নির্বাচনে আসবে না, বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নির্বাচনে অংশ নেবে না বাম জোটও। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অবশ্য মনে করছেন, বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নিলেও মাঠে তাদের প্রার্থী ঠিকই থাকবে। অর্থাৎ ‘স্বতন্ত্র’ মোড়কে প্রার্থী থাকবে বিএনপিরও। ফলে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে থাকবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী।

এ ছাড়া ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগে গৃহকোন্দলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অন্য দলের প্রার্থী কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের মারপ্যাঁচে যেন জয় ছিনিয়ে নিতে না পারে, এ বিষয়ে দল থেকে ‘কঠোর’ বার্তা দেওয়া হচ্ছে। দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর এটি আরও কঠোর হবে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সঙ্গে রাখা হচ্ছে চৌদ্দ দলীয় জোটের শরিকদেরও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৪ দলীয় জোটের দুই শরিক দল ৫ সিটির নির্বাচনে প্রার্থিতা চাইছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড় দিতে নারাজ। এ জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন অবশ্য প্রার্থিতার বিষয়ে তার দলের অনাগ্রহের বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন এরই মধ্যে। আমাদের সময়কে তিনি বলেছেন, ৫ সিটিতে দলগতভাবে ওয়ার্কার্স পার্টি অংশ নেবে না।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নির্বাচনে দলগতভাবে অংশ নেবে, নাকি আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দেবে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার বলেন, আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি, আলোচনা চলছে। জোটের আরেক শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়া জানান, তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন।

এদিকে জাতীয় পার্টি আগামী ৫ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। এরই মধ্যে গাজীপুরে তাদের একজন প্রার্থীকে (জিএম কাদের পন্থি) প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে।

গত ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের (রসিক) নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। বিশাল ব্যবধানে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হন তিনি। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অবস্থান হয় চতুর্থ। এটিই ভাবিয়ে তুলছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে। তাদের ধারণা, রংপুর সিটি নির্বাচনে দলের নেতাকর্মীরাও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি, ভোটও দেননি। ৫ সিটির আসন্ন নির্বাচনে যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, খুলনায় তালুকদার খালেক, রাজশাহীতে এইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও বরিশালে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে ফের মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে তারা সবুজ সংকেত পেয়ে গেছেন বলেও গুঞ্জন আছে। অন্যদিকে সিলেটে সিটি করপোরেশনে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিষয়ও নিশ্চিত। দলীয় হাইকমান্ড থেকে তাকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গতকাল বলেন, মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি দলের হাইকমান্ড দেখছে। আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে কয়েক বছর ধরে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রার্থী। এ পর্যন্ত গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল হাসান রাসেল সরকার, যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম, ৩৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল্লাহ আল মামুন ম-ল এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতি।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান। তবে সেই নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী প্রয়াত এমএ মান্নানের কাছে পরাজিত হন। পরেরবার মনোনয়ন চাইলেও তাকে না দিয়ে অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। জাহাঙ্গীর জয়লাভ করেন। পরে নানা ঘটনায় সমালোচনার জন্ম দিয়ে দল ও মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হন তিনি। সম্প্রতি তাকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তবে মেয়র পদ ফিরে পাননি এখনো। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের রায় কয়েক দফা পিছিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কোন্দলে বিপর্যস্ত গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ। একপক্ষে রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান আর অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে বিচরণ করে জাহাঙ্গীর আলমও তৃণমূলে বহু কর্মী-সমর্থক তৈরি করেছেন। জাহাঙ্গীরের কর্মী-সমর্থকদের মতে, দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হলে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন জাহাঙ্গীর আলম।

জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান জানান, বহু দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে কাজ করে আসছেন। দলীয় প্রধান এবার তাকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নেবেন বলে আশা করছেন তিনি।

মহানগরের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ। ‘ভাগ্যক্রমে’ দুই মেয়াদের অধিকাংশ সময় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সে অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি এবার মেয়র পদে আ.লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি।

গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল হাসান রাসেল সরকার দীর্ঘদিন ধরেই মেয়র পদে প্রার্থী হতে এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানা উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন।

মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় নানা উন্নয়নমূলক কাজ করছেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। মুজিববর্ষে ব্যক্তিগত অর্থায়নে শতাধিক অসহায়ের মধ্যে বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন তিনি, যা দলের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

মতিউর রহমান মতি গাজীপুরের প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ভাই, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এবার তিনিও মেয়র পদে মনোনয়ন চান। তবে নানা বিতর্কিত কর্মকা-ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যে কারণে তার ভাতিজা জাহিদ আহসান রাসেলই তার পাশে নেই।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আমাদের নির্দেশনা একটাই তা হলো- একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দল নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। অতঃপর দল ও দলের সহযোগী এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা মানুষের দোরগোড়ায় গিয়ে মানুষের মন জয় করে ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইবে। এরপর মানুষ যাকে ভোট দিবে আমরা তাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা রাখব।’

বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না এমনটা শোনা যাচ্ছে। ফলে নির্বাচন কী সাদামাটা হবে? উত্তরে আবদুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন সাদামাট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, বিএনপি তাদের কাগুজে কথায় নির্বাচনে অংশ নেয় না। বাস্তবে তারা ওই যে বলে না- মাংস খায় না ঝোল খায়। প্রার্থী ঠিকই দেয় কিন্তু ভাসুরের নামটা মুখে নেয় না। সুতরাং ওই নির্বাচন সাদামাটা হওয়ার সুযোগ নেই।’

আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১২ জুন খুলনা ও বরিশালে ও ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন হবে ইভিএমের মাধ্যমে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *