মরছে উপকারী কীটপতঙ্গ উর্বরতা হারাচ্ছে জমি

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


ফসল উৎপাদনে পরাগায়ণের বিকল্প নেই। আর পরাগায়ণের ক্ষেত্রে কীটপতঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, দেশে আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে ফসলের জন্য উপকারী কীটপতঙ্গ। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় শস্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, ভয়াবহ সংকটে পড়বে পুরো কৃষি ব্যবস্থা। কেন কমে যাচ্ছে কীটপতঙ্গ? এ প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেক কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আবাসস্থল ক্রমেই কমে যাওয়া; জমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিকের অব্যাহত প্রয়োগ; পরিবেশের দূষণ বৃদ্ধি; আগ্রাসী প্রজাতির পতঙ্গের বিস্তার; জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন ইত্যাদি অন্যতম।

প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়েছে। উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক এ কৃষিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ও উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার বেড়েছে। জমিতে কাঙ্ক্ষিত ফসল ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভিদ রোধে ব্যবহার হচ্ছে আগাছানাশক বা হার্বিসাইড। আগাছা উৎপাটনে শ্রমিকের পেছনে যে ব্যয়, সেটি বাঁচাতে ব্যবহার করা হচ্ছে হার্বিসাইড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশকের প্রয়োগে উপকারী পোকামাকড়ের ডিম, লার্ভা মারা যায়। শুধু তাই নয়, রাসায়নিক ও কীটনাশকের কারণে জনস্বাস্থ্য তো বটেই, পুরো প্রাণিকুলই মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, জমিতে দেওয়া বালাইনাশক বৃষ্টিতে পানির সঙ্গে মিশে যায়। সেই পানি গিয়ে মেশে নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়ে। ফলে এসব জলাধারের পানিও বিষাক্ত হয়ে যায়। এতে করে মাছের ডিম নষ্ট হয়ে যায়, মাছের বেঁচে থাকায়ও প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। এ কারণেই এখন অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে পাখিকুলও বিপন্ন; হারিয়ে যাচ্ছে আরও অনেক প্রাণী।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রজব আলী বলেন, কীটনাশক প্রয়োগের সময় আমরা ভাবি ক্ষতিকারক পোকাগুলো মারা যাবে। কিন্তু এর সঙ্গে উপকারী পোকারাও মারা যায়। আমাদের অসচেতনতায়-অবহেলায় এসব উপকারী পোকামাকড় মারা যাচ্ছে। যার ফলে ফসলের পরাগায়ণ ব্যবস্থা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, সাধারণভাবে ক্ষতিকর বলে পরিচিত কীটপতঙ্গের প্রকৃতিতে অপরিসীম উপকারী ভূমিকা রয়েছে। উদ্ভিদের পরাগায়ণ থেকে শুরু করে প্রতিবেশে সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা পায় কীটপতঙ্গের মাধ্যমে। যেমন মৌমাছি, প্রজাপতি, রেশমকীট, ঘাসফড়িং ইত্যাদি। মৌমাছি ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে এবং মৌচাকে জমা করে। এ ছাড়া মৌমাছি বিভিন্ন ফসলের পরাগায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পতঙ্গের আরেকটি সুপরিচিত দল পিঁপড়া। এরা আমাদের উচ্ছিষ্ট খাবার এবং অন্য মৃত পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশকে সুন্দর রাখে।

বিলুপ্তির কারণ
কীটপতঙ্গের বিপন্ন হওয়ার পেছনে চারটি প্রধান কারণ খুঁজে বের করেছেন বিজ্ঞানীরা। এগুলো হচ্ছে এক. আবাসস্থল ধ্বংস : তৃণভূমি ও বনভূমি পরিবর্তন করে কৃষিজমি তৈরি করা। পাশাপাশি বাড়ছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পতঙ্গকুল। দুই. পরিবেশদূষণ : অধিক হারে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ত্বরান্বিত করছে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি। কৃষিতে অধিক উৎপাদনের আশায় ক্ষতিকর পতঙ্গের পাশাপাশি আমরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে উপকারী পতঙ্গও ধ্বংস হচ্ছে। তিন. জৈবিক সমস্যা : ভিনদেশি আগ্রাসী প্রজাতির দ্বারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কীটপতঙ্গ। এক প্রতিবেশের প্রাণী অন্য প্রতিবেশে স্থানান্তরের মাধ্যমে বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে অসংখ্য পতঙ্গ। চার. জলবায়ু পরিবর্তন : এতে একদিকে যেমন বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তেমনি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বেশিসংখ্যক পতঙ্গের প্রজাতি।

বিজ্ঞানীর বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া অনেক পোকামাকড়ের জন্য কঠিন। যেমন ভোমরা মূলত ঠা-া এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে অভ্যস্ত। ফলে অপেক্ষাকৃত গরম আবহাওয়ায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আবার ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি বেড়ে যায়, তবে হুমকির মুখে পড়বে শস্য উৎপাদন।

করণীয়
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দুনিয়ার ছোট-বড় প্রতিটি জীবেরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা জরুরি। কীটপতঙ্গ নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা করে এদের সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিলে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্য, রক্ষা পাবে কৃষিও।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বাংলাদেশে কীটনাশক এবং সার ব্যবহারের যে নীতিমালা রয়েছে, তা মানা হচ্ছে না। দেশের অধিকাংশ কৃষক অশিক্ষিত। যত বেশি কীটনাশক প্রয়োগ করা হবে, তত ভালো হবে এমন ভাবনা থেকে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করছেন তাদের অনেকেই। ফলে ক্ষতিকারকের পাশাপাশি উপকারী পোকাও মারা যাচ্ছে। পুরো প্রাণিকুলেরই স্থাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মানুষের শরীরে যে নানা রোগ দানা বাঁধছে, তার জন্য কীটনাশকও দায়ী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *