র্যাব হেফাজতে মৃত্যুবরণ করা সুলতানা জেসমিনের লাশ দাফনের পুরো কার্যক্রমও হয়েছে এই এলিট ফোর্সেরই তত্ত্বাবধানে। আটকের পর নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা; অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর তার দাফন পর্যন্ত চার দিন কোনো আত্মীয়স্বজনকে জেসমিনের পাশে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেসমিনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন স্বজনরা। কিন্তু র্যাব সদস্যরা তাদের কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছিলেন। হাসপাতালে ভর্তিসহ দাপ্তরিক সব নথিপত্রেও র্যাব সদস্যদের নাম রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার কারণে কিছু কাজ সম্পন্ন করেছে পুলিশ।
জেসমিনের মামা সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু জানান, জেসমিনকে যেদিন আটক করা হয়, সেদিন দুপুরে তার ফোন থেকে তার ছেলেকে কল করে মায়ের অসুস্থতার কথা জানানো হয় এবং নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে আসতে
বলা হয়। খবর পেয়ে তিনিও হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে দেখতে পান, জেসমিনকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। মন্টু বলেন, সে সময় আমি জেসমিনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সে কোনো কথা বলতে পারছিল না। র্যাবের পোশাকে কয়েকজন সেখানে ছিলেন।
তিনি জানান, জেসমিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ২২ মার্চ রাত ৯টার দিকে নওগাঁ থেকে তাকে রামেক হাসপাতালে নেওয়া হয় র্যাবের গাড়িতেই। সেখানেও জেসমিনকে ভর্তি করান র্যাব সদস্যরাই। নওগাঁ সদর হাসপাতাল থেকে একটি মাইক্রোবাসে র্যাব সদস্যরা জেসমিনকে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই মাইক্রোবাসে ছিলেন জেসমিনের দুলাভাই আমিনুল। মাইক্রোবাসেই জেসমিনের খিঁচুনি শুরু হয়, সে কথা বলতে পারছিল না।
মন্টু বলেন, রামেক হাসপাতালে গিয়েও আর কথা বলতে পারেনি জেসমিন। আমিনুলকে র্যাব কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছিল। তাদের হেফাজতেই ছিল আমিনুল। পরিস্থিতি দেখে সে বাড়ি ফিরতে চাইলেও তাকে ফিরতে দেওয়া হচ্ছিল না। পরে সোহাগ ও সন্ধ্যা নামে দুজনকে নওগাঁ থেকে রামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। তাদের পাঠানোর পর আমিনুল বাড়ি ফেরার সুযোগ পায়। পরে জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত হাসপাতালে পৌঁছলে সোহাগ ও সন্ধ্যাকে বাড়ি ফেরার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের কাউকেই জেসমিনের সেবা-শুশ্রষা করতে দেওয়া হয়নি। সারাক্ষণ র্যাব সদস্যরা পাহারায় ছিলেন।
জানা গেছে, জেসমিনকে প্রথমে রামেক হাসপাতালের ৮নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। রোগীর রেজিস্ট্রারে লেখা হয়েছে ‘সুলতানা জেসমিন, সি/ও (কেয়ার অফ) সাহেদ, গ্রাম: র্যাব-৫।’ তবে জেসমিনের মৃত্যুর পর রেজিস্ট্রার খাতায় জেসমিনের নাম ঠিক রেখে সি/ও মনোয়ার হোসেন, গ্রাম- হাজি মনসুর রোড, খাস নওগাঁ, নওগাঁ সদর লেখা হয়েছে। এই ঠিকানা সংশোধনের তারিখ ২৪/৩/২০২৩। খাতায় লেখা ফোন নম্বরটিও র্যাবের এক নারী সদস্যের। আনসার ব্যাটালিয়ন থেকে আসা ওই নারী র্যাবে কর্মরত।
আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিন মারা যাওয়ার পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাজপাড়া থানায় খবর দেয় রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওয়ার্ড মাস্টারের ডেথ রেজিস্ট্রারের খাতায় নাম লেখার সময় জেসমিনের আত্মীয়দের খোঁজ করে কর্তৃপক্ষ। তার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বরও চাওয়া হয়। কিন্তু তখন জেসমিনের কোনো আত্মীয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এ সময় উপস্থিত র্যাবের এক সদস্য একটি মোবাইল নম্বর দেন। জেসমিনের নামের সঙ্গে লেখা ওই নম্বরটিও র্যাবের এক এসআইয়ের। ডেথ রেজিস্ট্রার থেকে নম্বরটি নিয়ে কল করা হলে রিসিভ করে নিজের নাম মাসুম বিল্লাহ ও র্যাব-৫ কর্মরত এসআই বলে ওই প্রান্ত থেকে পরিচয় দেওয়া হয়। অপর প্রান্ত থেকে আরও বলা হয়, ‘ওইদিন আমি হাসপাতালে যাইনি। কেউ হয়তো আমার নম্বরটা লিখে দিয়েছে।’
এ বিষয়ে র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার আমাদের সময়কে বলেন, রামেক হাসপাতালে নেওয়ার সময় জেসমিনের সঙ্গে তার দুলাভাই আমিনুল ছিলেন। তবে ভর্তি থেকে ডেথ রেজিস্ট্রার বা অন্যান্য ক্ষেত্রে জেসমিনের নিকটাত্মীয় কারও নম্বর কেন দেওয়া হয়নি, তা জানি না। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।
এদিকে সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তৈরিতে আরও সময় লাগবে। রামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন জানান, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও হার্টফেল মৃত্যুর কারণ বলে মৃত্যুসনদে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক। এ জন্য জেসমিনের হার্টও সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্যাথলজি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সব রিপোর্ট পেলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। আরও চার-পাঁচ দিন লাগতে পারে।