শাহবাগ, এবং যারা বিভাজন করে

বাধ ভাঙ্গা মত

‘একতাই শক্তি’ এটা সবাই জানে এবং বিশ্বাস করে। স্বার্থান্বেষী দুর্জনেরা ব্যক্তি স্বার্থের প্রলোভনে একত্রিত না থাকতে পারলেও, একতাই যে শক্তি সেটা বুঝে খুব ভালোভাবেই। আর তাই সকল ক্ষেত্রে তারা সেই শক্তিতে ফাটল ধরানোর চেষ্টায় রত থাকে। লক্ষ মানুষের একতাই শাহবাগের শক্তি। এই শক্তিকে ভেঙে দিতে পারলে এদেশের চিরায়ত জনস্বার্থ বিমুখ, নীতিহীন রাজনীতি এবং ক্ষমতায়নের খেলা নির্বিঘ্নে চলতে পারে। তাইতো সেই অপরাজনীতির স্বার্থ হাসিলে কেউ কেউ শাহবাগের শক্তি কাজে লাগানো, কেড়ে নেয়া, বা থামিয়ে দেয়া সকল চেষ্টায়ই মগ্ন আছে। কারণ শাহবাগের শক্তি তাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
মুখপাত্র, অন্যতম সংগঠক, কর্মী, নেতা- এসব পদবি নিয়ে যে টানাহেঁচড়া শুরু হয়েছে , আমি বরং এসব পদবির বাইরে গিয়ে শাহবাগে আসা এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষদের একজন বা শাহবাগ নিয়ে স্বপ্ন দেখা একজন হিসেবেই আমার ভাবনাগুলো তুলে ধরছি। মঞ্চের একজন হিসেবে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে হতে হয় এবং মঞ্চ নিয়ে যা কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব মানুষের মনে তৈরি হয়েছে বা ছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই লেখা।
শাহবাগ অবশ্যই একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, কিন্তু নির্দলীয়। যারা এটাকে অরাজনৈতিক বলেন, আমি তাদের সাথে একমত না। মঞ্চের কর্মীরা রাজনীতি বোঝে না, এটার সাথেও একমত না আমি। এখানে মেধাবী মানুষদের ভিড় আছে, যারা অনেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত না, কিন্তু রাজনীতি বোঝে ভালোভাবেই। হয়ত চলমান রাজনীতিতে গা মেশায় না অনেকেই। এদেশের মানুষ এবং রাজনীতিবিদরা সাধারণত যে রাজনীতি দেখে এবং দেখিয়ে অভ্যস্ত তা হলো- ক্ষমতাদখল, দলীয়করণ, দলবাজি, অপপ্রচার, নিজের স্বার্থে মানুষকে ব্যবহার তথা প্রতিহিংসার রাজনীতি; যার সাথে মানুষের কল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। মঞ্চ অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করে, তাই অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতো হিংস্র হয়ে উঠেনি।
তাই যারা দল করেন, রাজনীতি বোঝার ক্রেডিট জাহির করতে চান তাদের এটা জেনে রাখা ভালো যে, মঞ্চে অনেকেই আছে দল না করেও খুব ভালো রাজনীতি বোঝেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, যে কূটচালে আমাদের রাজনীতি অভ্যস্ত মঞ্চকর্মীরা তা করবে কিনা। একজন সচেতন, মেধাবী মানুষের পক্ষে খুব নোংরা পলিটিক্স করা সম্ভব না, কিন্তু পলিটিক্স করা সম্ভব। তাই মঞ্চকর্মীদের রাজনীতি না বোঝার অজুহাতটা আরেক অপরাজনীতি।
শাহবাগ আন্দোলন একটি গ্ল্যামারাস আন্দোলন। মিডিয়া এবং ক্যামেরা বরাবরই সে আন্দোলন এবং সেখানকার মানুষের জন্য ছিল। কিন্তু কিছু মানুষ ছিল ক্যামেরার জন্য। আজ যারা মঞ্চকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে আমি দেখতাম তারা কি ধাক্কাধাক্কি করছে যেখানে ক্যামেরা আছে সেখানে যাওয়ার জন্য। এই গুঁতাগুঁতি, ধাক্কাধাক্কিতে অংশগ্রহণকারীরাই এখন বিভিন্ন গ্রুপিংয়ের চেষ্টায় মগ্ন। মিছিলে, সমাবেশে, অনুষ্ঠানে চেহারা দেখানোওয়ালাদের ধাক্কাধাক্কিতে আমি ক্লান্ত ও লজ্জিত হই। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে প্রয়োজনে ক্যামেরাই তাকে খুঁজে নেবে। ভবিষ্যতে তাদের এই চেহারা দেখানোই হয়ত অন্য কোনো চেহারায় রূপ নেবে! শিখলাম এটা ক্যামেরার রাজনীতি। এই চেহারা দেখানোর খায়েশ থেকেই হয়ত এখন চলছে প্রেস কনফারেন্সের ট্রেন্ড। কিন্তু মঞ্চে এমন মানুষও আছে দিনরাত কাজ করেছে মঞ্চের জন্য, কখনো ক্যামেরার সামনে আসেইনি।
এদিকে গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে চলতে থাকল টাকা আত্মসাতের অপপ্রচার। ইমরান এইচ সরকার এবং মঞ্চের বিরুদ্ধে এত এত টাকা আত্মসাতের অভিযোগ যারা আনলো তারা কেউ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারল না। সি.সি. ক্যমেরা থাকা স্বত্ত্বেও দেখাতে পারল না শেরাটনে (বর্তমান হোটেল রূপসী বাংলা) থাকার কোনো ভিডিও ফুটেজ। রাজনৈতিক দলগুলোতে সাধারণত টোকাই বা অভাবগ্রস্ত অথবা অনেক টাকাওয়ালা মানুষদের ভিড় থাকে, যোগ্যতার বালাই সেখানে নেই বললেই চলে। আমাদের রাজনীতিতে মানুষের যোগদানের অন্যতম কারণ টাকা। হয় তারা রাজনীতি করবে টাকার জন্য, অথবা টাকা দিয়ে রাজনীতি করবে ক্ষমতার জন্য। মানুষের দোহাই দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে চলছে রাজনীতি। কর্মী সংখ্যা বাড়াতে, মিছিলে বা সমাবেশে লোক সমাগম বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোকে খরচ করতে হয় টাকা। কারণ এরা কেউই দেশপ্রেম থেকে রাজনীতি করে না। তাই শাহবাগকেও এর বাইরে তারা ভাবতে পারেনি। তাদেরই কেউ কেউ হয়ত শাহবাগেও এসেছিল একই উদ্দেশ্য থেকে। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা টোকাই না, বা এখানে কেউ টাকা দিয়ে ক্ষমতা কিনতেও আসেনি। বরং এ এমন এক আন্দোলন যেখানে টোকাই থেকে বিত্তবান সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আর আন্দোলনের সময় বিত্তবান বা ভিক্ষুক নিজে থেকেই অনুদান দিয়েছে- সেটা হোক এক বোতল পানি, বিস্কুট অথবা বিরিয়ানি। তাই অপপ্রচার বন্ধ করে এখান থেকে সকলে বিশেষ করে পেশাদার রাজনৈতিকরা শিক্ষা নিতে পারেন, কোন রাজনৈতিক চর্চা তারা করবেন, যেখানে থাকবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
এর আগে মঞ্চের কর্মীদের ওপর নাস্তিকতার দায় চাপানোর চেষ্টাও চলল মেলা দিন। গুজবে বিশ্বাসী এ দেশের সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদের এটাও বিশ্বাস করানোর চেষ্টা হলো। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা বা ধর্মের লেবাস নিয়ে রাজনীতি এদেশে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আছে। এখানেও সেই চেষ্টা চালানো হলো। শাহবাগ আন্দোলনে আসা যে কর্মীর বুকে তার মা দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিত বা দিনরাত শাহবাগ পড়ে আছে বলে যে কর্মীর মা পূজা শেষে তার সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছিল অথবা যে পরিবার গির্জায় যাওয়ার আগে বা পরে শাহবাগ হয়ে যেত কিংবা যে প্যাগোডায় একদিন আন্দোলনকারীদের মঙ্গল কামনায় ‘ওম শান্তি’ বলে প্রার্থনা করা হয়েছিল, তাদের সবাইকে আখ্যায়িত করা হলো নাস্তিক বলে। কি অদ্ভুত কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাজনীতি! আর একজন নাস্তিককেই বা নিষিদ্ধ করার অধিকার কে রাখে? ধর্মে বিশ্বাস রাখা যেমন মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার, তেমনি ধর্মে বিশ্বাস না রাখাও একজন মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। স্বার্থান্বেষীরা এখানেও চেষ্টা করল অসাম্প্রদায়িক এই আন্দোলনকে ধর্মের লেবাসে এনে বিভাজন তৈরি করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়।
বিভিন্নভাবে স্বার্থ হাসিলে মঞ্চকে ব্যাবহার করা বা থামিয়ে দেয়ার যে পাঁয়তারা চলছে সেটা আসলে কতদূর সফল হবে- যেখানে মঞ্চ তৈরি হয়েছে এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণে, তাই এখন প্রশ্ন। হেফাজত-শিবির যে ভাঙন তৈরি করতে পারেনি, সেই ভাঙন তৈরির চেষ্টা করল কারা? শিবির-হেফাজতি ভাষায় চেতনাধারীরা! সেই চিরচেনা ক্ষমতার চেতনা! শিবির-হেফাজতের ধর্মের লেবাস আর তাদের চেতনার লেবাস। মাঝখানে এদেশের মানুষ ও গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষেরা এখন আর অন্ধকারে নেই যে, তারা কিছু না বুঝেই আপনাদের ধর্মের বা চেতনার শিকার হবে। এদেশের মানুষ এখন সচেতন তার অধিকার সম্পর্কে। তারা ভালোবাসে এই দেশকে। তারা প্রস্তুত সব মোকাবেলা করার। শাহবাগে যারা এসেছিল আবেগ থেকে, টাকা-পয়সা বা অবস্থানের হিসাব-নিকাশ তারা করে না। যে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করার চেষ্টা করা হচ্ছে, হিসাব-নিকাশের চেষ্টা চলছে তা কতটা স্বার্থ হাসিল করবে? অহিংস মঞ্চকে দুর্বল ভাবার অবকাশ নেই। এ মঞ্চ ছড়িয়ে গেছে দেশের আনাচে-কানাচে, মানুষের চেতনায়। মানুষ জেগে উঠলে সকল ষড়যন্ত্র ভেসে যাবে।
যেহেতু ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না তাই ক্ষমা করবে না কউকেই- সে যেই হোক। আপনি, আমি বা সে। বিষয় হলো কে সত্য? মানুষ সত্যের পক্ষে। আশা করি এ লেখা থেকে প্রশ্নকর্তারা বা গুজবে বিশ্বাসীরা বুঝতে পারবেন কোনটা সত্য। যে শাহবাগের মানুষের আবেগ নিয়ে খেলবে সেই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। (পরিবর্তন)
জ্যোতিকা জ্যোতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *